সূচীপত্র
বিয়ের ক্ষেত্রে সাধারণ যেখানে কাবিন করা যায় না-সেখানেই হলফনামা করা হয় কিন্তু হলফনামার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু চলুন জেনে নিই আজ– বিয়ের হলফনামা তৈরির নিয়ম ২০২৩
বিয়ের হলফনামা কেন করতে হয়? – প্রচলিত অর্থে, কোর্ট ম্যারেজ বলতে সাধারণত হলফনামার মাধ্যমে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ ঘোষণা করাকে বোঝায়। এই হলফনামাটি ৩০০/- টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখে নোটারি পাবলিক বা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সম্পন্ন করা হয়। এটি একটি বিয়ের ঘোষণা মাত্র।
বিভিন্ন কাজে হলফনামা সম্পাদনের প্রয়োজন পড়ে। বিশেষ করে জমি কেনাবেচা, বিবাহ কিংবা বিচ্ছেদ, নাম পরিবর্তন বা সংশোধনসহ বিভিন্ন কাজে এর প্রয়োজন হয়। তা ছাড়া বিভিন্ন দলিল তৈরির কাজেও লাগে হলফনামা। নিয়মকানুন মেনেই তা সম্পাদন করতে হয়। আসুন, জেনে নিই হলফনামা করতে কী কী মানতে হবে।
হলফনামা কি বিয়ের দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য? কক্সবাজার জেলা সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, গ্রামগঞ্জে বেশীর ভাগ বাল্যবিবাহে কন্যা অল্প বয়সী নাবালিকা হওয়ার ফলে কাবিননামা নিবন্ধন করতে ব্যর্থ হয়ে, অনেকে নোটারী পাবলিকের ‘হলফনামা’ অথবা স্থানীয় ভাবে ৩ শ’ টাকা মূল্যমানের নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে লিখিত ‘বিবাহের চুক্তিনামা’ করে থাকেন। যা আইনে কোন বৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা নাই। সে সব হলফনামা বা চুক্তিনামা মূলে কেউ আইনগত ভাবে স্বামী/স্ত্রী বা বিবাহের স্বীকৃতি আদায় কিংবা কোন প্রতিকার পেতে পারে না। মুসলিম বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত আইন ও বিধি মতে, বিবাহের একমাত্র শর্ত কাবিননামা নিবন্ধন করা।
বিয়ের হলফনামা না করলে কি হয়? / সাধারণত বিয়ের হলফনামা কখন করা হয়
অনেক ক্ষেত্রে কন্যার বয়স ১৮ বছরের কম (বাল্যবিবাহ), অসম বিবাহ, পরকীয়ার বিবাহ, একাধিক বিবাহ, অবৈধ ও অপ্রকাশ্য বিবাহ কার্যাদী সম্পাদনে এমন বিয়ের ‘হলফনামা/চূক্তিনামা” করা এবং তা আইনগত বিয়ের ডকুমেন্ট মনে করা হয়ে থাকে, যা সম্পূর্ণ ভুল ও অসচেতনতা। এমন ‘বিবাহের হলফনামা’ বা ‘বিবাহের চুক্তিনামা’ গুলো মূলতঃ ফেরবী, অকার্যকর ও অবৈধ হিসেবে পরিগনিত হয়। কাবিননামা ব্যতীত বিবাহ সংক্রান্তে অন্য কোন চুক্তিনামা/হলফনামা আইনে বৈধ না। এমন চুক্তিনামা/হলফনামা স্বামী বা স্ত্রী স্বীকৃতি প্রদান বা পরিচয় বহন করে না। দেশে, সমাজে অসংখ্য সংস্থা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ নিলেও, বারবার সচেতনতা সৃষ্টি করলেও, গ্রামগঞ্জে তা তোয়াক্কা না করে বাল্যবিবাহ সমূহে প্রায় এমন ‘ বিবাহের হলফনামা/চূক্তিনামা” দেদারসে হচ্ছে আর বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েরা এর পরিণাম ভুগছে। দু’একটি কেস স্টাডির কথা উল্লেখ করছি।
Caption: Holofnama or Affidavit Word File Download
হলফনামা করার নিয়ম ২০২৩ । আসুন, জেনে নিই হলফনামা করতে কী কী মানতে হবে
- হলফনামাতে হলফকারীর পূর্ণ নাম, ঠিকানা, বাবা-মায়ের নাম, জাতীয়তা, বয়স, পেশা ও ধর্ম উল্লেখ করতে হবে। সঙ্গে দিতে হবে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর। হলফকারী ব্যক্তি কী বিষয়ে, কী কারণে ও কেন হলফ করছেন, তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিতে হবে।
- বিয়ে সংক্রান্ত হলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের নাম, বাবা-মায়ের নাম, ঠিকানা, বয়স ও পেশা উল্লেখ করতে হবে। বিয়ের তারিখ, কত টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়েছে এবং দেনমোহরের কত টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, সেটাও উল্লেখ থাকতে হবে।
- বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে কী কারণে তালাক দেওয়া হয়েছে, এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে হবে। তবে বিয়ের হলফনামায় স্বামী-স্ত্রী দুজনের স্বাক্ষর লাগবে। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে যিনি বিবাহবিচ্ছেদের হলফনামা করছেন, শুধু তিনি স্বাক্ষর দেবেন।
- যেকোনো হলফনামায় অবশ্যই যে তারিখে হলফনামাটি সম্পাদন করা হচ্ছে, সেই তারিখটি লিখতে হবে।
- নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পূর্ব নাম কী ছিল এবং বর্তমান নামে কী সংশোধন হয়েছে, তা স্পষ্ট করে লিখতে হবে।
- হলফনামা সম্পাদন করতে হয় ২০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে। তবে বিবাহবিচ্ছেদের হলফনামা করতে হবে ৫০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে। হলফনামা লেখার পর (কম্পোজ বা টাইপ) নোটারি পাবলিক বা প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে সত্যায়ন করাতে হবে। নিয়ম হচ্ছে যিনি হলফনামাটি করলেন, তিনি নোটারি পাবলিক কিংবা প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তাঁর হলফনামাটি সম্পর্কে সত্যপাঠ করবেন।
- তখন নোটারি পাবলিক বা ম্যাজিস্ট্রেট হলফনামাটি যাচাই-বাছাই করে এর ওপর স্বাক্ষর দেবেন এবং একটি বিশেষ সরকারি সিল ব্যবহার করে এতে ক্রমিক নম্বর বসাবেন। হলফনামাটির একটি ফটোকপি তিনি রেখে দেবেন।
- নোটারি পাবলিক থেকে নোটারি করার সময় নোটারি পাবলিকের সনদ নম্বর জেনে নেওয়া উচিত। নোটারি পাবলিক ভুয়া কি না, তা যাচাই করে নিতে হবে। কোনো পেছনের তারিখ দিয়ে হলফনামা সম্পাদন করা উচিত নয়।
- জমি কেনাবেচার দলিলের সঙ্গে দলিল নিবন্ধনের সময় হলফনামা দিতে হয় সাবরেজিস্ট্রি অফিসে।
বিবাহ হলফনামায় কি কি ঘোষণা থাকতে হয়?
আমরা উভয়ে সুস্থ, বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ও নিজেদের ভাল-মন্দ বিবেচনা করার বোধশক্তি এবং আইনতঃ অধিকার আমাদের আছে। আমরা উভয় পক্ষ দীর্ঘদিনের পরিচয় সূত্রে উভয়ে উভয়কে ভালোবাসিয়া আসিতেছি। উক্ত ভালোবাসাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে আমরা উভয়ে বিবাহ বন্ধঁনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য জীবন-যাপনে সম্মত হই। আমরা উভয়ে অদ্য………………ইং তারিখ ইসলামী শরীয়তের বিধান মতে ও দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে একজন মাওলানা সাহেবের মাধ্যমে শুভ বিবাহের পবিত্র আকদ্ পড়িয়া উভয়ে উভয়কে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে কবুল করিয়া নিলাম। আমাদের অত্র বিবাহে ২য়পক্ষের/ কনের মোহরানা ……………………. ……….. টাকা নির্ধারণ করিয়া তৎমধ্যে স্বর্ণালংকার ও কাপড়- চোপড় বাবদ নগদ……………… টাকা মোহরানা আদায় ও বাকী …………… …টাকা ২য় পক্ষ চাহিবে মাত্র আদায়ে এবং মাসিক যুগোপযোগি খোরপোষ প্রদানে ১মপক্ষ/বর অঙ্গীকারবদ্ধ হইলাম।
আমি ১ম পক্ষ/স্বামী আমার স্ত্রী ………………-কে স্ত্রীর পূর্ণ মর্যাদা দিব। সামাজিক মোতাবেক চালাইব, নিজেও চলিব। নিয়মিত ভরণ- পোষণ ও খোরপোষ দিব। তাকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন অথবা যৌতুক সহ কোন ধরণের অনৈতিক দাবী করিব না। যদি করি কি করাই, আইন আদালতে দন্ডনীয় অপরাধী হইব এবং আমি ২য় পক্ষ/ স্ত্রী আমার স্বামী……………..-কে স্বামীর পূর্ণ মর্যাদা দিব। সামাজিক মোতাবেক চলিব। সুখে-দুঃখে তাহার সঙ্গে থাকিব। তাহার যাবতীয় আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ মানিয়া চলিব। অত্র বিবাহে কেহ আমাদেরকে কোন ভাবে প্ররোচিত, প্রভাবিত ও প্রলোভিত করে নাই। অত্র যৌথ বিবাহের হলফনামা আমরা স্বেচ্ছায় সম্পাদন পূর্বক আইনগতভাবে আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে সুখে-শান্তিতে দাম্পত্য জীবন যাপন করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হইলাম। আমাদের এই বিবাহ কাজী অফিসে খুব শীঘ্রই রেজিঃযুক্ত কাবিননামা সম্পাদন করিয়া নিব। কাজী অফিসে রেজিঃযুক্ত কাবিননামা সম্পাদন না হওয়া পর্যন্ত অত্র যৌথ বিবাহের হলফনামা কাবিননামার বিকল্প হিসেবে বিবাহের পূর্ণাঙ্গ শর্তাদিসহ বলবৎ ও কার্যকর থাকিবে। এই করারে, স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে ও সরল অন্তরে আমরা ১ম ও ২য় পক্ষ অদ্য ……………..তারিখ …………… …………….. কার্যালয়ে হাজির হইয়া নিজ নিজ নাম দস্তখত করিয়া দিলাম।
হলফনামা দিয়ে কি মামলা চলে?
না। তানিয়া (ছন্মনাম) দুই শিশু সন্তান সহ আইনজীবীর চেম্বারে এসেছেন তার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে। কিশোরী তানিয়ার জন্ম নিবন্ধন সনদ ও বিবাহের প্রমাণ স্বরূপ তিন শ’ টাকা মূল্যমানের নন জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে লিখিত একটি ‘বিবাহের চুক্তিনামা’। বিজ্ঞ আইনজীবী নিজের মোবাইলে তানিয়ার জন্ম সনদ যাচাই করে দেখলেন, তানিয়া জন্ম তারিখ অনুযায়ী বর্তমান বয়স মাত্র সাড়ে ১৬ বছর। আর কম্পিউটার টাইপ করে স্ট্যাম্পে লেখা ‘বিবাহের চুক্তিনামা’ মতে, ৩ বছর আগে তার বাল্য বিয়ে কালীন সময়ে তার বয়স ছিল মাত্র সাড়ে ১৩ বছর! বিজ্ঞ আইনজীবী দ্বীধাঁয় পড়ে গেলেন, কোন আইনে মামলা করবেন? এক দিকে সাড়ে ১৩ বছর বয়সে নাবালিকা তানিয়ার স্বাক্ষর করা ‘বিবাহের চুক্তিনামা’ এতটুকু বৈধতা বহন করে না, অন্য দিকে তার কোলে দুই শিশু সন্তান। আইনের দৃষ্টিতে ঐ চুক্তিনাামা একে তো কোন প্রতিকার মিলবে না, উল্টো এমন চুক্তিনামা করার অপরাধে মেয়েটির অভিভাবক ও চুক্তিনামা যারা করেছে, তারা সহ স্বাক্ষীরাও ফেঁসে যাবে! আবার এখনো নাবালিকা তানিয়ার কোলে দুই শিশু সন্তান ও স্বামী-সংসারের বোঝা!