আগুন নিয়ে নতুন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অন্যান্য নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বেঁচে থাকার পাশাপাশি আগুন থেকে বাঁচতেও আমাদের সচেতনতার ঘাটতিও সম্প্রতি স্পষ্ট হয়েছে। এসব নিয়ে একদিকে যেমন প্রচার-প্রচারণা তেমন নেই ঠিক তেমনি এ বিষয়ক নিয়ন্ত্রক সংস্থাও তেমন তৎপর নয় । ফলে প্রতিবছর বাংলাদেশে অনেক মানুষ মারা যায় অগ্নিকাণ্ডে। এসব মৃত্যুর জন্য যতটা না আগুন দায়ী, তার চেয়ে আমাদের অসচেতনতা বড় ভূমিকা রাখে। অগ্নিকাণ্ডে আক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন না অন্যদিকে অক্সিজেনের অভাবে দম বন্ধ হয়েই বেশি মারা পড়ে। এ সময় অনেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না তার এখন কী করা উচিত বা করনীয় কী। থাকে না আমাদের কোনো পূর্বপ্রস্তুতিও। এর ফলে মৃতের সংখ্যাই শুধুই বাড়ে।
আগুন বিষয়ে আমাদের কি কি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত এবং আগুন থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যাবে সেসব প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় আজ তুলে ধরা হলো। অগ্নিকাণ্ডের জন্য যদি পূর্বপ্রস্তুতি থাকে, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি যেমন কমানো সম্ভব, অনেক অমূল্য প্রাণও বাঁচানো সম্ভব । এ জন্য কিছু কিছু সাধারণ প্রস্তুতি থাকা উচিত সবারই।
আগুন লাগার আগে কি কি সতর্কতা নেয়া উচিত- আসুন সেগুলো জানি
১. স্বয়ংক্রিয় ফায়ার অ্যালার্মের ব্যবস্থা রাখা:
বসতবাড়িতে বা অফিসে স্বয়ংক্রিয় ফায়ার অ্যালার্মের ব্যবস্থা রাখা উচিত যাতে করে সবাই সতর্ক হতে পারে । অগ্নিনির্বাপক অ্যালার্ম মাঝেমধ্যে রাতে বাজিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন, পরিবারের সবাই অ্যালার্ম শুনে সতর্ক হচ্ছেন কি না। সতর্ক না হলে তাঁদের বারবার অনুশীলন করাতে হবে।
২. পরিবারের সবাইকে আগুনের বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন করা:
স্বয়ংক্রিয় ফায়ার অ্যালার্মের ব্যবস্থা না থাকলেও পরিবারের সবাইকে আগুনের বিষয়ে সতর্ক করতে হবে। আগুন লাগলে কে কোথায় আশ্রয় নেবেনে, তা আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রাখতে হবে এবং সবাইকে জানাতে হবে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে কীভাবে নিরাপদ স্থানে পৌঁছানো যায়, তা মাঝে মধ্যে অনুশীলন করে দেখতে পারেন। পরিবারে বয়স্ক কোন সদস্য থাকলে তাদের বিষয়ে জোর দিয়ে ভাবতে হবে।
৩. বাসা বড় কোন ভবনে হলে:
বাসা যদি দোতলা বা তার ওপরের ফ্লোরে হয়, তাহলে কীভাবে বাসা থেকে বের হবেন, তার পূর্বপ্রস্তুতি নিন। এ ক্ষেত্রে জানালা ভালো উপায় হতে পারে আর তাই অগ্নিকাণ্ডের সময় জানালা গলে বের হওয়া যায় এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে। কারখানায় ইমারজেন্সি সিড়ি থাকে। অগ্নিকান্ডের সময় লিফট ব্যবহার করবেন না, বরং ইমারজেন্সি সিড়ি ব্যবহার করুন। বাড়ির চারপাশে কোন কোন ধরনের দুর্যোগ ঝুঁকি রয়েছে সেগুলো জেনে রাখুন। দ্রুত আশ্রয় গ্রহণের মতো কোথায় ফাঁকা বা নিরাপদ স্থান আছে সেটাও জেনে রাখুন।
৪. ঘরের ভেতরে দাহ্য তরল রাখা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকুন
আপনার ঘরে বা আশেপাশে দাহ্য পদার্থ নেই তো? যদি কোন কারনে রাখতেও হয় তবে অন্তত তার আশপাশে ধূমপান থেকে বিরত থাকুন। এমনকি চুলা বা মশার কয়েল থেকে দূরে থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখুন।
৫. রান্না করার সময় সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। গ্যাসের চুলা অযথা জ্বালিয়ে রাখা উচিত নয়, যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করলে সিলিন্ডার নিরাপদ স্থানে রাখুন। গ্যাসের আগুন পানিতে নিভাতে যাবেন না। বরং বালু বা ভেজা ছালা দিয়ে আগুন নিভাতে চেষ্টা করুন।
৬. দেশলাই বা ম্যাচ বাক্স যথাসম্ভব বাচ্চাদের নাগালের বাইরে রাখুন। দেশলাই কখনো চুলা বা মশার কয়েলের আশপাশে রাখা উচিত নয়, এতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
৭. ধূমপান অভ্যাস থাকে অবশ্যই সিগারেটের অবশেষ অংশ নিভিয়ে ফেলা উচিত। যেখানে–সেখানে জ্বলন্ত সিগারেটের অংশ ফেলা উচিত নয় কারন এ থেকেই বড় কোন দুর্ঘটনা হতে পারে।
৮. নিকটবর্তী ফায়ার সার্ভিস অফিসের নম্বর সংগ্রহ করে রাখুন। প্রয়োজনে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে তাদের মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিস অফিসের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
৯. বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন এবং প্রধান সুইচগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করুন। কোনো ভবনে আগুন লাগলে সবার আগে দ্রুত বিদ্যুৎ ও গ্যাসের প্রধান চাবি অর্থাৎ মেইন সুইচটি বন্ধ করতে হবে। ভবনের প্রতিটি সদস্যকে জানতে হবে যে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মেইন সুইচ কোথায়। সঙ্গে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ নিয়মিত পরীক্ষা করাতে হবে। কেননা ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ আগুনের ভয়াবহতা বাড়ার অন্যতম কারণ।
১০. জরুরি ব্যাগ প্রস্তুত রাখা
দুর্যোগের সময় চিন্তুাভাবনা করে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো একসঙ্গে নিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকে না। তাই জরুরি অবস্থা, দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের সময় যেসব জিনিস আমাদের প্রয়োজন হয় তা আগে থেকেই রাখতে হবে। এটিকে বলা হয় ইমার্জেন্সি বা জরুরি ব্যাগ। কিছু প্রাথমিক জিনিসের নাম দেওয়া হলো যা জরুরি যেমন- বহনযোগ্য লাইট, প্রয়োজনীয় ওষুধ, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, জায়গা-জমির দলিল, ব্যাংকের কাগজপত্র ইত্যাদি। এটা একেকজনের একেক রকম হতে পারে। অবার অফিসেরটা আলাদাও হতে পারে।
আগুন লাগলে কী করবেন- আসুন তা জানি?
১. আগুন লাগলে সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করব। বৈদ্যুতিক উৎসের আগুন হলে তাৎক্ষণিক প্লাগ খুলে ফেলব, মেইন সুইচ বন্ধ করে দেব। পানি ব্যবহার করব না।
২. রান্নার পাত্রে তেল লাগা আগুনে কখনই পানি ঢালব না। ঢাকনা বা ভেজা চটের বস্তা বা কাপড় দিয়ে পাত্রটি ঢেকে দেব। গ্যাসের আগুন পানিতে নিভাতে যাবেন না। বরং বালু বা ভেজা ছালা দিয়ে আগুন নিভাতে চেষ্টা করুন। আক্রান্ত ভবনের আশপাশে ভিড় না করে ফায়ার সার্ভিসের কাজে সহযোগিতা করব।
৩. পোশাকে আগুন লাগলে দৌড়াব না, মেঝেতে বা মাটিতে গড়াগড়ি দেব। সব ধরনের আগুন নেভাতে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করব। আগুন লাগলে তাড়াহুড়ো না করে লাল রং চিহ্নিত রাস্তা দিয়ে বের হব।
৪. আগুন বিভিন্ন কারণে লাগতেই পারে। আপনার এর জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে। আগুন লাগলে কার কী কর্তব্য সেটা জানতে হবে। প্রতিটি বিল্ডিংয়ের একটা আপৎকালীন পরিকল্পনা থাকতে হবে, যাতে এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়। আগুনে আতঙ্কিত না হয়ে করণীয় জানতে হবে। গায়ে বা পরনের কাপড়ে আগুন ধরলে মাটিতে গড়াগড়ি করতে হবে। ধোঁয়া হলে হামাগুড়ি দিতে হবে। কারণ নিচে ধোঁয়া কম থাকে। নিচু হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে অথবা গড়াগড়ি করে বের হতে হবে।