সূচীপত্র
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সুপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করতে কার্যকর হয়েছে নতুন ‘সেট ব্যাক রুল’ বা নূন্যতম জায়গা ছাড়ার নিয়ম। এই নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ভবন নির্মাণের আগে তার চারপাশ দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা খালি রাখতে হবে। ভবনের জমির পরিমাণ (কাঠা) এবং প্রস্তাবিত ভবনের উচ্চতার ওপর ভিত্তি করে এই ছাড়ের পরিমাণ নির্ধারিত হবে।
সেট ব্যাক রুল (SetBack Rule) কী?
নির্মাণাধীন ভবনের চারদিকে নূন্যতম যে পরিমাণ জায়গা খালি রাখা বাধ্যতামূলক, তাকেই ‘সেট ব্যাক রুল’ বা ‘সেট ব্যাক’ বলা হয়। একটি নিরাপদ, আলো-বাতাসযুক্ত এবং সুপরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার জন্য এই নিয়ম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নিয়ম প্রধানত জমির পরিমাণ এবং ভবনের উচ্চতার ওপর নির্ভর করে।
মূল সেট ব্যাক নিয়মের বিশ্লেষণ
প্রদত্ত তালিকা অনুযায়ী, ইমারতের উচ্চতা যদি ৩০ মিটার বা ১০ তলা পর্যন্ত হয়, তবে জায়গা ছাড়ার নিয়মাবলী নিম্নরূপ:
| জমির পরিমাণ | উচ্চতা (তলা/কাঠা) | সম্মুখ সেট ব্যাক (মিটার) | পশ্চাৎ সেট ব্যাক (মিটার) | প্রতি পার্শ্ব সেট ব্যাক (মিটার) |
| ১৫৪ বর্গমিটার বা ৪ কাঠার নিচে | ২ কাঠা বা ২ তলার নিচে | ১.৫ মিটার | ১.০০ মিটার | ০.৫০ মিটার |
| ৪ থেকে ৫ কাঠা জমি | ৩ তলা বা তার বেশি | ১.৫০ মিটার | ২.০০ মিটার | ১.২৫ মিটার |
| ৫ থেকে ১০ কাঠা পর্যন্ত | ৪ থেকে ৯ তলা পর্যন্ত | ১.৫০ মিটার | ২.০০ মিটার | ১.২৫ মিটার |
| ১০ কাঠা থেকে ১৫ কাঠা পর্যন্ত | ১০ তলা পর্যন্ত | ১.৫০ মিটার | ২.০০ মিটার | ১.২৫ মিটার |
| ১৫ কাঠা থেকে ২০ কাঠা পর্যন্ত | ২০ তলা পর্যন্ত | ১.৫০ মিটার | ২.০০ মিটার | ১.২৫ মিটার |
উদাহরণ: যদি কোনো জমির পরিমাণ ৪ থেকে ৫ কাঠা হয় এবং ভবনের উচ্চতা ১০ তলা (বা তার নিচে) হয়, তবে ভবন মালিককে সামনে ১.৫ মিটার, পিছনে ২.০ মিটার এবং উভয় পাশে ১.২৫ মিটার করে নূন্যতম জায়গা খালি রাখতে হবে।
⏫ উচ্চ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ম
যদি ইমারতের উচ্চতা ৩০ মিটার বা ১০ তলার বেশি হয়, তবে জমির পরিমাণ নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রেই নূন্যতম জায়গা ছাড়ার হার পরিবর্তন হবে:
সম্মুখ সেট ব্যাক: ১.৫ মিটার
পশ্চাৎ সেট ব্যাক: ২.৫ মিটার
প্রতি পার্শ্ব সেট ব্যাক: ১.৫ মিটার
সাধারণ নির্দেশনা
এই নিয়মাবলী মেনে চলার মাধ্যমে ভবন মালিকেরা আইনি জটিলতা এড়াতে পারবেন এবং একটি পরিবেশবান্ধব ও সুশৃঙ্খল নির্মাণকাজ নিশ্চিত করতে পারবেন। নির্মাণ কাজের পূর্বে অবশ্যই জমির পরিমাণ ও ভবনের উচ্চতা অনুযায়ী সঠিক সেট ব্যাক পরিমাপ নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।

অন্যের সীমানা ঘেষে বাড়ি করার শাস্তি কি?
অন্যের সীমানা ঘেঁষে বা অনুমোদিত সেট ব্যাক রুল (SetBack Rule) লঙ্ঘন করে বাড়ি নির্মাণ করা একটি গুরুতর আইনি অপরাধ। বাংলাদেশে এই ধরনের অননুমোদিত নির্মাণের জন্য নিম্নলিখিত আইন ও শাস্তির বিধান রয়েছে:
এখানে আইনগতভাবে দুটি প্রধান সমস্যা তৈরি হয়:
১. ভবন নির্মাণ আইন লঙ্ঘন (সেট ব্যাক): কর্তৃপক্ষের (যেমন রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা) অনুমোদন ছাড়া বা অনুমোদিত নকশার শর্ত ভেঙে নির্মাণ করা। ২. ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর অনুপ্রবেশ/ক্ষতিসাধন: প্রতিবেশীর জমিতে সরাসরি প্রবেশ করা বা তার সম্পত্তির ক্ষতি করা।
⚖️ আইন ও শাস্তি (বাংলাদেশ)
মূলত ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২ এবং সংশ্লিষ্ট ইমারত নির্মাণ বিধিমালা দ্বারা এই অপরাধগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়।
১. ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২ অনুযায়ী শাস্তি:
যদি কেউ যথাযথ কর্তৃপক্ষের (যেমন রাজউক, সিটি কর্পোরেশন) অনুমোদন ছাড়া অথবা অনুমোদনের শর্ত লঙ্ঘন করে (যার মধ্যে সেট ব্যাক রুল ভঙ্গ করাও অন্তর্ভুক্ত) কোনো ইমারত নির্মাণ করেন, তবে:
কারাদণ্ড: দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ সাত (৭) বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
অর্থদণ্ড: অন্যূন পঞ্চাশ হাজার টাকা (৳৫০,০০০) পর্যন্ত অর্থদণ্ড হতে পারে।
উভয় দণ্ড: আদালত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড উভয়ই দিতে পারেন।
ভবন অপসারণ: আদালত বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ (যেমন রাজউক) অননুমোদিতভাবে নির্মিত ইমারত বা তার অংশবিশেষ ভেঙে ফেলার বা অপসারণের নির্দেশ দিতে পারে। অপসারণের খরচও নির্মাণকারীকেই বহন করতে হয়।
২. ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ অনুযায়ী শাস্তি:
যদি প্রতিবেশী সীমানা ঘেঁষে নির্মাণ করার সময় আপনার জমির সীমানা বা সীমানা চিহ্নের ক্ষতিসাধন করেন অথবা আপনার ভূমি বা উহাতে অবস্থিত স্থাপনা/বৃক্ষের কোনো ক্ষতি করেন, তবে:
এই নতুন আইন অনুযায়ী এটি ভূমি অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে এবং ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিবেশী থানায় বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মামলা দায়ের করতে পারেন।
আইনটি এই ধরনের সীমানা বা ভূমির ক্ষতিসাধনের জন্য দণ্ডের বিধান রেখেছে।
৩. দেওয়ানী প্রতিকার:
যদি কর্তৃপক্ষ (সিটি কর্পোরেশন, রাজউক) কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিবেশী দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে পারেন। এই মামলার মাধ্যমে:
আদালত নির্মাণ কাজ বন্ধ করার জন্য স্থগিতাদেশ (Stay Order) দিতে পারে।
অননুমোদিত বা সীমানা লঙ্ঘনকারী অংশটি ভেঙে ফেলার জন্য আইনি নির্দেশ দিতে পারে।
একজন ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিবেশীর করণীয়
যদি আপনার সীমানা ঘেঁষে কেউ সেট ব্যাক নিয়ম লঙ্ঘন করে বাড়ি নির্মাণ করেন, তবে দ্রুত নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া উচিত:
১. আলোচনা: প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবেশীর সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করুন এবং আইনগত নিয়মগুলো তাকে অবগত করুন। ২. লিখিত অভিযোগ: আপনার এলাকার রাজউক / সিটি কর্পোরেশন / পৌরসভা / ইউনিয়ন পরিষদ-এর কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করুন। তারা পরিদর্শন করে পরিমাপ করবে এবং অননুমোদিত নির্মাণ হলে নোটিশ দিয়ে কাজ বন্ধ করতে পারে। ৩. সাধারণ ডায়েরি (GD): যদি নির্মাণ কাজ আপনার জায়গায় অনুপ্রবেশ করে বা ক্ষতির কারণ হয়, তবে স্থানীয় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (GD) করতে পারেন। ৪. আইনি পদক্ষেপ: স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নিলে, দ্রুত একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে দেওয়ানি আদালতে মামলা (যেমন: চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার মামলা) দায়ের করতে পারেন।
সংক্ষেপে, সেট ব্যাক রুল না মেনে বা অন্যের সীমানা লঙ্ঘন করে বাড়ি করলে জেল, জরিমানা, এবং নির্মিত স্থাপনা ভেঙে ফেলার আদেশ—এই সব ধরনের শাস্তির ঝুঁকি থাকে।
প্রতিবেশী বাসা থেকে বেরুনোর রাস্তা না দিলে কি করবেন?
যদি আপনার প্রতিবেশী আপনাকে আপনার বাসা থেকে বেরোনোর জন্য রাস্তা দিতে অস্বীকার করেন, তবে এটি একটি গুরুতর সমস্যা এবং এর জন্য বাংলাদেশে আইনগত প্রতিকার রয়েছে। এই পরিস্থিতিকে ‘পথের অধিকার’ বা ‘Right of Way’ সংক্রান্ত বিরোধ বলা হয়।
পথের অধিকার সম্পর্কিত আইনি প্রতিকারগুলো সাধারণত সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, ১৮৭৭ (Specific Relief Act, 1877) এবং সুযোগ সুবিধা আইন, ১৮৮২ (The Easements Act, 1882) দ্বারা পরিচালিত হয়।
আইনি ভিত্তি ও প্রতিকার
আপনার জমির সাথে সংযুক্ত রাস্তা না থাকলে, আপনি সাধারণত নিম্নলিখিত দুই ধরনের অধিকার বলে পথ দাবি করতে পারেন:
১. স্বত্বাধিকার বা চিরস্থায়ী পথ (Easement of Necessity)
যদি আপনার জমিটি এমনভাবে ঘেরা থাকে যে, অন্য কোনোভাবে জনসাধারণের রাস্তায় যাওয়া সম্ভব নয়, তবে আপনি “অত্যাবশ্যকীয় স্বত্বাধিকার” (Easement of Necessity) বলে আপনার প্রতিবেশীর জমির ওপর দিয়ে রাস্তা বা পথ দাবি করতে পারেন।
সংজ্ঞা: যখন কোনো জমিকে ব্যবহারযোগ্য করার জন্য অন্য কোনো সংলগ্ন জমির ওপর দিয়ে পথ ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে, তখন সেই অধিকারকে ‘স্বত্বাধিকার’ বলে। এই ধরনের অধিকারকে আইন স্বীকৃতি দেয়।
আইন: সুযোগ সুবিধা আইন, ১৮৮২-এর ধারা ১৩ (Section 13) অনুযায়ী, এই অধিকার জন্মায়।
২. দখলী স্বত্বাধিকার বা দীর্ঘদিনের ব্যবহারজনিত পথ (Prescriptive Easement)
যদি আপনি বা আপনার পূর্বপুরুষেরা একটানা ২০ বছর বা তার বেশি সময় ধরে প্রতিবেশীর জমির ওপর দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে এবং প্রকাশ্যভাবে কোনো বাধা ছাড়াই পথ ব্যবহার করে আসছেন, তবে আপনি সেই পথের ওপর ‘দখলী স্বত্বাধিকার’ (Prescriptive Easement) অর্জন করেছেন বলে গণ্য হবেন।
আইন: সুযোগ সুবিধা আইন, ১৮৮২-এর ধারা ২৬ (Section 26) অনুযায়ী, এই অধিকার সুরক্ষিত।
আপনার করণীয় পদক্ষেপ
যদি প্রতিবেশী পথ দিতে না চান, তবে নিম্নলিখিত ধাপে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন:
১. শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও নোটিশ (প্রথম ধাপ)
আলোচনা: প্রথমে প্রতিবেশীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে আলোচনা করে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করুন।
আইনি নোটিশ: আলোচনা ব্যর্থ হলে, একজন আইনজীবীর মাধ্যমে প্রতিবেশীর কাছে একটি আইনি নোটিশ (Legal Notice) পাঠান। নোটিশে আপনার পথের অধিকারের আইনি ভিত্তি (যেমন: অত্যাবশ্যকীয় স্বত্বাধিকার) উল্লেখ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পথ খুলে দেওয়ার দাবি করুন।
২. দেওয়ানি আদালতে মামলা (দ্বিতীয় ধাপ)
আইনি নোটিশের পরও যদি প্রতিবেশী রাস্তা না দেন, তবে আপনাকে আদালতে যেতে হবে।
মামলার প্রকৃতি: আপনার জমিটি যে আদালতে বিচার্য, সেই দেওয়ানি আদালতে প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে “সুনির্দিষ্ট প্রতিকারের মামলা” (Suit for Specific Relief) দায়ের করতে হবে।
দাবি: এই মামলায় আপনি আদালতকে নিম্নলিখিত আদেশ জারির জন্য অনুরোধ করবেন:
আপনার প্রতিবেশীর জমিতে আপনার প্রবেশাধিকার বা পথ ব্যবহার করার অধিকার ঘোষণা করা।
প্রতিবেশীকে স্থায়ীভাবে আপনার পথ ব্যবহার করতে বাধা না দেওয়ার জন্য স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা (Permanent Injunction) জারি করা।
প্রমাণ: আদালতে আপনার জমি ও প্রতিবেশীর জমির দলিল, এবং পথ ব্যবহার সংক্রান্ত প্রমাণ (যেমন: পুরোনো রেকর্ড, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাক্ষ্য, বা জমির ম্যাপে পথের অবস্থান) উপস্থাপন করতে হবে।
৩. ফৌজদারি পদক্ষেপ (যদি বাধা গুরুতর হয়)
যদি প্রতিবেশী শারীরিকভাবে বা দেয়াল তুলে আকস্মিকভাবে আপনার রাস্তা বন্ধ করে দেন, যা আপনার চলাচলে সরাসরি বাধা সৃষ্টি করে, তবে দ্রুত প্রতিকার পেতে আপনি:
স্থানীয় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (GD) বা অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।
ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ (Code of Criminal Procedure)-এর ১৪৪ ধারা অনুযায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা করতে পারেন, তবে এই পথে যাওয়া উচিত সর্বশেষ উপায় হিসেবে।
গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ: যত দ্রুত সম্ভব একজন অভিজ্ঞ দেওয়ানি আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করুন। তিনি আপনার জমির দলিল এবং পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সঠিক আইনি পথ এবং প্রয়োজনীয় প্রমাণ সংগ্রহে সহায়তা করবেন।
