সূচীপত্র
ঢাকা, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫: বাংলাদেশে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের একটি অপরিহার্য ধাপ হলো রেজিস্ট্রেশন, যা ক্রেতার জন্য একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া। ২০২৫ সালের নতুন আইন অনুযায়ী, জমির রেজিস্ট্রেশন ফি এবং অন্যান্য সরকারি করের হার নির্ধারণ করা হয়েছে, যা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকা ক্রেতার জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই ফি ও করের হার জমির অবস্থান ভেদে ভিন্ন হয়।
রেজিস্ট্রেশন ফি (২০২৫) – কোথায় কত খরচ?
জমি রেজিস্ট্রেশনের সময় ক্রেতাকে মূলত পাঁচটি খাতে সরকারি ফি পরিশোধ করতে হয়: স্ট্যাম্প ডিউটি, রেজিস্ট্রেশন ফি, স্থানীয় সরকার কর, উৎসে আয়কর (Source Tax), এবং ভ্যাট (VAT)।
| এলাকার অবস্থান | স্ট্যাম্প ডিউটি | রেজিস্ট্রেশন ফি | স্থানীয় সরকার কর | উৎসে আয়কর (Source Tax) | ভ্যাট (VAT) | মোট খরচ |
| মহানগর, জেলা শহর ও পৌরসভা | ৫% | ১% | ২% | ৬% | ২% | মোট মূল্যের ১২.৫% |
| ইউনিয়ন পরিষদ এলাকা | ১৫০০ টাকা (স্থিরকৃত) | ১% (সর্বনিম্ন ১০০০ টাকা) | ৩% (সর্বনিম্ন ৩০০০ টাকা) | ২% (সর্বনিম্ন ২০০০ টাকা) | ২% (সর্বনিম্ন ২০০০ টাকা) | মোট ৯,৫০০ টাকা |
উদাহরণ:
মহানগর/পৌরসভা এলাকায়: যদি ১ লক্ষ টাকার জমি কেনা হয়, তবে মোট খরচ হবে ১২,৫০০ টাকা (১,০০,০০০ টাকার ১২.৫%)।
ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায়: ১ লক্ষ টাকার জমি কিনলেও নির্ধারিত সর্বনিম্ন ফি বাবদ মোট খরচ হবে ৯,৫০০ টাকা।
ক্রেতাকে কেন সতর্ক থাকতে হবে?
জমি রেজিস্ট্রেশনের সরকারি খরচ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে অনেক সময় অসাধু দলিল লেখক বা মধ্যস্বত্বভোগী নির্ধারিত হারের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করতে পারে। সরকারি ফি সম্পর্কে জানলে ক্রেতা অনাকাঙ্ক্ষিত খরচ থেকে বাঁচতে পারবেন এবং একটি সুষ্ঠু লেনদেন নিশ্চিত করতে পারবেন।
গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা: সরকারি নির্ধারিত খরচ ব্যতীত দলিল লেখকের নিজস্ব পারিশ্রমিক, ফটোকপি বা ছবি তোলার খরচ আলাদা হতে পারে। এসব খরচ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে অবশ্যই রশিদ নিতে হবে।
জমি কেনার আগে যা যা যাচাই করা আবশ্যক
শুধু রেজিস্ট্রেশন খরচ জানাই যথেষ্ট নয়, জমিটি ক্রয়ের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অবশ্যই যাচাই করতে হবে:
১. মালিকানার বৈধতা: বিক্রেতা যে জমির প্রকৃত ও বৈধ মালিক, তা নিশ্চিত করুন। এই ক্ষেত্রে খতিয়ান, পর্চা ও পূর্ববর্তী দলিলের কপি ভালোভাবে পরীক্ষা করা দরকার। জমিটি বিক্রেতার নামে নামজারি (মিউটেশন) করা আছে কিনা, তা যাচাই করা অত্যাবশ্যক।
২. আইনি জটিলতা: প্রস্তাবিত জমিতে কোনো ধরনের মামলা বা আইনি জটিলতা আছে কিনা, তা সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিস বা ভূমি অফিসে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হতে হবে।
৩. বন্ধক/ঋণ: জমিটি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ধক রাখা আছে কিনা, সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া জরুরি।
৪. জমির দাগ ও নকশা: বর্তমান নকশা অনুযায়ী জমির দাগ নম্বর ও অবস্থান সঠিক আছে কিনা, তা মিলিয়ে দেখুন। প্রয়োজনে একজন অভিজ্ঞ আমিন (সার্ভেয়ার)-এর সাহায্য নিয়ে জমির চৌহদ্দি (সীমানা) সরেজমিনে চিহ্নিত করা উচিত।
জমি কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতার সচেতনতা এবং সরকারি খরচ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান একটি ঝামেলামুক্ত মালিকানা পরিবর্তনে সহায়ক হবে।
৫ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রেশন করতে সর্বমোট কত খরচ হবে?
জমির রেজিস্ট্রেশন খরচ কত হবে, তা জানতে হলে শুধুমাত্র জমির পরিমাণ (৫ শতাংশ) জানাই যথেষ্ট নয়। খরচ নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত তিনটি প্রধান তথ্য জানা অত্যন্ত জরুরি:
১. জমির অবস্থান: জমিটি কোন এলাকায় অবস্থিত?
* মহানগর, জেলা শহর, বা পৌরসভা এলাকা? (এখানে খরচ মোট মূল্যের ১২.৫% হারে প্রযোজ্য।)
* ইউনিয়ন পরিষদ এলাকা? (এখানে খরচ প্রায় ৯,৫০০ টাকা (স্থিরকৃত ফি ও সর্বনিম্ন ফি প্রযোজ্য) বা জমির মূল্য অনুযায়ী কিছুটা কম/বেশি হতে পারে।)
২. জমির মোট মূল্য বা দলিল মূল্য (দলিলপত্রে প্রদর্শিত মূল্য): ৫ শতাংশ জমির সরকারিভাবে নির্ধারিত বাজার মূল্য বা আপনি যে দামে কিনছেন, সেই মূল্য কত?
৩. জমির প্রকৃতি: জমিটি কি কৃষি জমি, না আবাসিক/বাণিজ্যিক ভিটা? (উৎসে আয়করের হার কিছুটা ভিন্ন হতে পারে।)
উদাহরণস্বরূপ হিসাব (যদি মূল্য জানা থাকে):
ধরা যাক, আপনার ৫ শতাংশ জমির দলিল মূল্য (বা বাজার মূল্য) হলো ১০,০০,০০০ টাকা (দশ লক্ষ টাকা)।
১. মহানগর/জেলা শহর/পৌরসভা এলাকার ক্ষেত্রে (মোট খরচ ১২.৫%)
| খরচের খাত | শতকরা হার | টাকার পরিমাণ (১০ লক্ষ টাকার ওপর) |
| স্ট্যাম্প ডিউটি | ৫% | ৫০,০০০ টাকা |
| রেজিস্ট্রেশন ফি | ১% | ১০,০০০ টাকা |
| স্থানীয় সরকার কর | ২% | ২০,০০০ টাকা |
| উৎসে আয়কর (Source Tax) | ৬% | ৬০,০০০ টাকা |
| ভ্যাট (VAT) | ২% | ২০,০০০ টাকা |
| সর্বমোট সরকারি খরচ | ১২.৫% | ১,৬০,০০০ টাকা |
২. ️ ইউনিয়ন পরিষদ এলাকার ক্ষেত্রে (মোট খরচ ৯,৫০০ টাকা বা তার কাছাকাছি)
ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় খরচ সাধারণত স্থিরকৃত ও সর্বনিম্ন ফি অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। যদি আপনার ৫ শতাংশ জমির দলিল মূল্য ১০,০০,০০০ টাকা হয়, তবুও সেখানে মোট ৯,৫০০ টাকা (স্থিরকৃত ও সর্বনিম্ন ফি) প্রযোজ্য হবে।
| খরচের খাত | টাকার পরিমাণ |
| স্ট্যাম্প ডিউটি | ১৫০০ টাকা (স্থিরকৃত) |
| রেজিস্ট্রেশন ফি | ১% (তবে সর্বনিম্ন ১০০০ টাকা) |
| স্থানীয় সরকার কর | ৩% (তবে সর্বনিম্ন ৩০০০ টাকা) |
| উৎসে আয়কর (Source Tax) | ২% (তবে সর্বনিম্ন ২০০০ টাকা) |
| ভ্যাট (VAT) | ২% (তবে সর্বনিম্ন ২০০০ টাকা) |
| মোট সর্বনিম্ন সরকারি খরচ | ৯,৫০০ টাকা |
| *তবে, জমির মূল্য বেশি হলে এবং শতাংশের হিসেবে এই ফি-গুলো ৯,৫০০ টাকার চেয়ে বেশি হলে, তখন শতাংশের হিসেবেই হিসাব করা হবে। |
ঢাকার মিরপুর কিনলে কত খরচ হবে?
মিরপুরে (ঢাকা) ৫ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রেশন করতে সর্বমোট কত খরচ হবে, তা জানতে হলে আপনাকে জমির মোট মূল্য বা সরকারিভাবে নির্ধারিত মৌজা মূল্য (Mouja Value) জানতে হবে। কারণ, ঢাকা মহানগরের রেজিস্ট্রেশন ফি মোট মূল্যের শতাংশের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।
আপনার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, মিরপুর এলাকা (ঢাকা সিটি কর্পোরেশন) “মহানগর, জেলা শহর ও পৌরসভা” ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত। এই এলাকায় জমি রেজিস্ট্রেশনের মোট সরকারি খরচ হবে জমির মোট মূল্যের ১২.৫%।
মিরপুরে ৫ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রেশন খরচের হার (মূল্যের ভিত্তিতে)
আপনার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী খরচগুলির বিভাজন নিম্নরূপ:
| খরচের খাত | শতকরা হার |
| স্ট্যাম্প ডিউটি | ৫% |
| রেজিস্ট্রেশন ফি | ১% |
| স্থানীয় সরকার কর | ২% |
| উৎসে আয়কর (Source Tax) | ৬% |
| ভ্যাট (VAT) | ২% |
| মোট সরকারি খরচ | ১২.৫% |
| (তবে, দ্রষ্টব্য: উপরের হারগুলোর যোগফল ১৬% হলেও, আপনার দেওয়া তথ্যে মোট খরচ ১২.৫% বলা হয়েছে।) |
উদাহরণস্বরূপ খরচ গণনা
যেহেতু আপনি জমির মূল্য উল্লেখ করেননি, তাই একটি কাল্পনিক মূল্য (Hypothetical Value) ধরে খরচটি গণনা করা হলো।
ধরা যাক, মিরপুরে আপনার ৫ শতাংশ জমির সরকারিভাবে নির্ধারিত মূল্য বা দলিল মূল্য হলো ৳ ৩০,০০,০০০ টাকা (ত্রিশ লক্ষ টাকা)।
| খরচের খাত | শতকরা হার | টাকার পরিমাণ (৳ ৩০,০০,০০০ এর ওপর) |
| মোট সরকারি খরচ | ১২.৫% | ৳ ৩,৭৫,০০০ টাকা |
হিসাব: ৳ ৩০,০০,০০০ এর ১২.৫% = ৳ ৩,৭৫,০০০ টাকা।
আপনার করণীয়
মিরপুরে জমির দাম তার অবস্থানের (যেমন: মূল সড়ক বা অলিগলি) ওপর নির্ভর করে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। সঠিক খরচ জানতে হলে:
১. নির্দিষ্ট মৌজা মূল্য যাচাই করুন: আপনাকে মিরপুরের যে এলাকায় জমি কিনছেন, সেই নির্দিষ্ট মৌজার জন্য সরকারিভাবে নির্ধারিত সর্বনিম্ন বাজার মূল্য (মৌজা মূল্য) যাচাই করতে হবে।
২. হিসাব করুন: জমির এই সর্বনিম্ন মূল্যের ওপর ১২.৫% হিসেব করলে আপনি রেজিস্ট্রেশন বাবদ সর্বমোট সরকারি খরচ জানতে পারবেন।
