ই নামজারি ও ভূমি কর

বন্টননামা ছাড়াই ওয়ারিশি জমি খারিজ ২০২৫ । বিরোধ থাকলে আইনি পথে সমাধানের সুযোগ আছে?

ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া জমি খারিজ (নামজারি) করার ক্ষেত্রে বন্টননামা দলিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলেও, সব ওয়ারিশ একমত না হলে এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে। তবে বর্তমান ভূমি আইনে এই জটিলতা নিরসনে বিকল্প পথ খোলা রাখা হয়েছে। সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী, সকল ওয়ারিশ যৌথভাবে আবেদন করলে বন্টননামা দলিল ছাড়াই তাদের নামে জমির যৌথ খতিয়ান সৃজন করা সম্ভব।

প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ওয়ারিশি জমি খারিজের জন্য সকল উত্তরাধিকারীকে প্রথমে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশন থেকে ওয়ারিশ সনদপত্র সংগ্রহ করতে হবে। এরপর স্থানীয় ভূমি অফিসে (এসি ল্যান্ড বা ইউনিয়ন ভূমি অফিস) খারিজের আবেদন করতে হবে।

বন্টননামা ছাড়া খারিজের পদ্ধতি: ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তির সকল ওয়ারিশ যৌথভাবে নামজারির আবেদন করলে (জমাভাগ ব্যতীত), কেবল ওয়ারিশ সনদের ভিত্তিতেই সহকারী কমিশনার (ভূমি) একটি খতিয়ানে মৃত ব্যক্তির মোট জমিতে প্রত্যেক ওয়ারিশের প্রাপ্য হিস্যা উল্লেখপূর্বক যৌথ খতিয়ান সৃজন করে দেবেন। এই প্রক্রিয়ায় বন্টননামা দলিলের প্রয়োজন হবে না। এটি নাগরিকদের ভোগান্তি কমাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

যদি বিরোধ থাকে অথবা পৃথক খতিয়ান প্রয়োজন হয়:

১. আংশিক খারিজ: যদি সকল ওয়ারিশ যৌথভাবে আবেদন করতে রাজি না হন, তবে যারা রাজি আছেন তাদের অংশ আলাদা করে আংশিক খারিজের আবেদন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ভূমি অফিস অন্য ওয়ারিশদের আপত্তি জানানোর সুযোগ দেবে।

২. পৃথক খতিয়ান (জমাভাগ): তবে যদি ওয়ারিশগণ জমিসমূহ দাগ অনুযায়ী ভাগ করে নিজেদের নামে পৃথক পৃথক খতিয়ান (জমাভাগ) সৃজন করতে চান এবং আলাদাভাবে খাজনা দিতে চান, তাহলে অবশ্যই একটি নিবন্ধিত আপোষ বন্টননামা দলিল সম্পাদন করতে হবে। বন্টননামা ছাড়া পৃথক খতিয়ান বা জমাভাগ আইনসিদ্ধ হবে না।

৩. আদালতের মাধ্যমে বণ্টন: যদি ওয়ারিশদের মধ্যে কোনো বিরোধ থাকে এবং সহমত না হয়, তবে আইনি জটিলতা নিরসনে আদালতে বণ্টন মামলা (Partition Suit) করার সুযোগ রয়েছে। আদালতের রায়ের মাধ্যমে জমির অংশ নির্ধারণ করে খারিজ করা সম্ভব।

গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা: বন্টননামা বা খারিজ না হওয়া পর্যন্ত জমির খাজনা নিয়মিত জমা রাখা অপরিহার্য। এতে ভবিষ্যতে যেকোনো আইনি জটিলতা এড়ানো যায়। পুরো প্রক্রিয়ায় একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। এভাবে, বন্টননামা দলিল না হলেও ওয়ারিশরা যৌথভাবে জমির মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন এবং বিরোধের ক্ষেত্রে আদালত বা আংশিক খারিজের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।

নামজারি বা মিউটেশন ছাড়া কি পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করা যায়?

না, সাধারণত নামজারি (মিউটেশন/খারিজ) ছাড়া পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করা আইনসম্মতভাবে কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ। তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্র ও নিয়ম রয়েছে যা বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে।

এখানে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হলো:

১. মূল আইনগত বাধ্যবাধকতা:

  • রেজিস্ট্রেশন (সংশোধন) আইন, ২০০৪ এর ৫২এ ধারা অনুযায়ী, সম্পত্তি বিক্রয়ের জন্য বিক্রেতা বা তার পূর্বসূরির নামে সম্পত্তির সর্বশেষ খতিয়ান থাকা আবশ্যক
  • পৈত্রিক বা ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিতে, নামজারি হলো সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মৃত মালিকের নাম বাদ দিয়ে নতুন ওয়ারিশদের নাম সরকারি ভূমি রেকর্ড (খতিয়ান) এবং খাজনা দাখিলায় অন্তর্ভুক্ত হয়। নামজারি না হলে সরকারি নথিতে বিক্রেতার মালিকানা স্পষ্ট হয় না।
  • সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে জমি বিক্রির দলিল রেজিস্ট্রি করার সময় বিক্রেতার নামে নামজারি খতিয়ান এবং হালনাগাদ খাজনার রশিদ (দাখিলা) থাকা বাধ্যতামূলক। এগুলো ছাড়া রেজিস্ট্রেশন না করার নিয়ম রয়েছে।

২. নামজারি ছাড়া বিক্রির সমস্যা:

নামজারি ছাড়া জমি বিক্রি করলে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়ের জন্যই নিম্নোক্ত সমস্যাগুলো হতে পারে:

  • দলিল বাতিল হওয়ার ঝুঁকি: ক্রেতার দলিল আইনি জটিলতায় বাতিল হতে পারে।
  • আইনি চ্যালেঞ্জ: ভবিষ্যতে অন্যান্য ওয়ারিশরা সহজে এই বিক্রিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, বিশেষত যদি বন্টননামা (Partition Deed) না করা হয়।
  • ব্যাংক লোন সমস্যা: নামজারি ছাড়া জমি বন্ধক রাখা বা মর্গেজ দিয়ে ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া যায় না।
  • অন্যান্য জটিলতা: পরবর্তীতে ক্রেতা জমিটি বিক্রি করতে গেলে অথবা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করতে গেলে জটিলতার সম্মুখীন হবেন।

৩. বিশেষ ক্ষেত্রে বিকল্প:

ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক কিছু নির্দেশনা রয়েছে, যেখানে কিছু ক্ষেত্রে নামজারি কিছুটা সহজলভ্য বা কিছুটা ব্যতিক্রম হতে পারে:

  • যৌথ নামজারি (বন্টননামা ছাড়া): ওয়ারিশদের মধ্যে যদি বন্টননামা না হয়, কিন্তু সব ওয়ারিশ যৌথভাবে (এজমালে) নামজারির আবেদন করেন, তবে কেবল ওয়ারিশ সনদের ভিত্তিতে সকলের নাম একটি খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করে নামজারি করা যায়। এই ক্ষেত্রে, যদিও দাগ অনুযায়ী ভাগ হয় না, তবুও আইনত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং খাজনা দেওয়া যায়।
  • রেকর্ডীয় মালিকানা: যদি সর্বশেষ চূড়ান্ত রেকর্ডে (যেমন, আরএস/বিআরএস) সরাসরি আপনার নাম থাকে, তবে কিছু ক্ষেত্রে আলাদা নামজারি ছাড়াই বিক্রি করা যেতে পারে। তবে পৈত্রিক সম্পত্তির ক্ষেত্রে রেকর্ডে সাধারণত মৃত ব্যক্তির নাম থাকে।

পরামর্শ:

আইনি জটিলতা এড়াতে এবং সম্পত্তির নিরঙ্কুশ মালিকানা নিশ্চিত করার জন্য পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রির আগে অবশ্যই সকল ওয়ারিশের নামে নামজারি (মিউটেশন) করে নেওয়া উচিত। যদি ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টন নিয়ে মতবিরোধ থাকে, তবে আদালতে বন্টন মামলা (Partition Suit) করে নিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *