আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় একটা কথা খুব বেশি প্রচলিত যে, আপনার যদি মামু, চাচা অথবা খালু না থাকে তবে আপনার ভাল চাকুরি পাওয়া সম্ভব নয়! অর্থাৎ আপনি যতই মাথার ঘাম ফেলে ভাল চাকুরির জন্য প্রস্তুতি নিন না কেন, ভাল রিটেন পরীক্ষা বা ভাইবা দিন না কেন আপনার ভাল চাকুরি হবে না! অনেকে ভাবেন চাকুরির খোঁজ থেকে শুরু করে, মৌখিক পরীক্ষা অনেক কিছু তেই আপনার নিয়ন্ত্রণ নেই, তাহলে মামু, চাচা ছাড়া আপনার চাকুরি কিভাবে হবে!
আসলেই কি বর্তমান বাস্তবতা এমনই? নাকি মেধা ও পরিশ্রম করে চাকুরির প্রস্তুতি নিলে ভাল চাকুরি পাওয়া সম্ভব?
আপনার যদি মামু, চাচা, খালু না থাকে অন্যদিকে আপনি হন্যে হয়ে চাকুরি খুঁজে থাকেন- তবে এই পোস্ট টি আপনার জন্যই।
আজ আমরা জানবো চাকরি খোঁজার আগে আপনি কিভাবে প্রস্তুতি নিবেন।
আপনার যদি চাকুরির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকে তবে নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করার পাশাপাশি প্রস্তুত করার পাশাপাশি চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা বাড়াতে পাবেন। আপনার যোগ্যতা বাড়াতে সাহায্য করবে নিচের পদক্ষেপগুলো।
সূচীপত্র
শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী ভাবুন
প্রথমেই আপনি আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অন্যান্য যোগ্যতা নিয়ে নিজেকে মূল্যায়ন করুন অর্থাৎ Self Assessment করুন। অর্থাৎ আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা কি? বিশ্ববিদ্যালয়,কলেজ কোন পর্বটি শেষ করেছেন? কি ডিগ্রি আপনার আছে? একাডেমিক ডিগ্রির বাইরে আর কোন অভিজ্ঞতা আছে কি না? শিক্ষাগত যোগ্যতা বা ডিগ্রি অনুযায়ী কোন কোন প্রতিষ্ঠানের কোন কোন চাকরিটি আপনার জন্য উপযোগী তার একটি তালিকা মনে মনে ভেবে রাখুন বা লিখে রাখুন। তাদের পুরনো জব সার্কুলার ঘেটে দেখতে পারেন তারা কি ধরনের যোগ্যতা চেয়ে থাকেন, Job Responsibility কি? এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে নিজেকে প্রস্তুত করুন।
আকর্ষনীয় সিভি তৈরি করুন
সিভি কে বলা যায় আপনার দর্পন বা আপনার প্রতিনিধি। চাকরি দাতার নিকট নিজেকে প্রকাশ করার প্রাথমিক মাধ্যম হল আপনার সিভি। একটি ভালো সিভি চাকরি দাতার নিকট আপনার যোগ্যতাই শুধু নয়,আপনার ব্যক্তিত্বও সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করবে। সিভি তৈরি করতে গিয়ে কখনোই অন্যের সিভি অনুকরণ করবেন না। কাউকে অনুকরণ করে গতানুগতিক ধারার সিভি তৈরি না করে,অন্য দশ জন থেকে নিজেকে অধিক যোগ্যতা সম্পন্ন ও ব্যক্তিত্ববান প্রকাশ করতে ভিন্ন ধারার সিভি তৈরি করুন। ভুল করে হলেও অন্যর সিভি কিংবা ওয়েব সাইট থেকে সিভির অন্ধ অনুকরণ করবেন না। আপনার সিভিতে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য দিবেন তা হলো-আপনার যোগ্যতা, দক্ষতা, ক্ষমতা,গুণাগুণ। এই গুন গুলো ভাল ভাবে তুলে ধরুন। নিজেকে সবার থেকে ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করুন আপনার চাকুরির নিয়োগ কর্তার নিকট। প্রয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের চাকরির জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সিভি তৈরি করুন। অন্যদিকে সবসময় সিভি আপডেট করুন। আরও দেখুন: যে সকল বিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠানে তদবির বা উৎকোচ ছাড়া চাকরি হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে সক্রিয় থাকুন
আপনার আশে পাশের মানুষগুলো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে থাকেন। ফেসবুক,ট্যুইটার, লিঙ্কডইন (ক্যারিয়ার নেটওয়ার্ক) তাদের মধ্যে অন্যতম। এইসব মাধ্যম গুলো আমাদের মধ্যে অনেকেই একধরনের বিনোদন মনে করে। বিনোদন হিসেবে নয়,নিজের চাকরির প্রয়োজনে এইসব মাধ্যম গুলোতে একাউন্ট করুন। বিভিন্ন সেক্টরের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করুন, আপনি জানেন না কে কখন আপনার কাজে লাগবে। যারা এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত,শুরুতেই তারা আপনাকে গুরুত্ব নাও দিতে পারে। তবুও নিয়মিত তাঁদের স্ট্যাটাস গুলো পড়ুন,লাইক দিন। গঠনমুলক মন্তব্য করুন। ধীরে ধীরে আপনি তাঁদের নজরে পড়বেন। আপনার প্রতি তাদের আস্থা আসবে। ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। ভালো যোগাযোগ তৈরি হলে একসময় সুফল পেতে শুরু করবেন। লিঙ্কডইন এখানে বড় একটি ভূমিকা পালন করতে পারে।
চাকুরি কোথায় খুঁজবেন এবং কিভাবে?
চাকরি খোঁজার অনেক প্রচলিত মাধ্যমের পাশাপাশি ইদানিং অনেক আধুনিক মাধ্যমও আছে। Website, Newspaper, Job Fair ইত্যাদি। বিভিন্ন Job Site গুলোতে গিয়ে চাকরির খোঁজ করুন, একাউন্ট খুলে নিজের সিভি তৈরি করুন। পাশাপাশি বিভিন্ন সংবাদপত্রে চাকরির বিজ্ঞাপন দেয়া থাকে। আবার কোন কোন পত্রিকা শুধু চাকরির বিজ্ঞাপনই প্রকাশ করে থাকে, সেধরনের পত্রিকা নিয়মিত সংগ্রহ করুন। অনেক সময় বিভিন্ন লাইব্রেরি,নিউজ স্টল গুলোতে চাকরির বিজ্ঞাপন গুলো বোর্ডে লাগিয়ে দেওয়া হয়। নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। জব ফেয়ার গুলোতে নিয়মিত যোগ দিন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে বছরের বিভিন্ন সময়ে জব ফেয়ার অনুষ্টিত হয়, সেগুলোতে অংশগ্রহন করে পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই চাকুরি পাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। যে সকল নিয়োগকর্তা জব ফেয়ারে অংশগ্রহন করে থাকে তারা সরাসরি নিয়োগ দিয়ে থাকেন। অনেক সময় ব্যক্তিগত যোগাযোগে চাকরি হয়। পরিচিত মানুষগুলোকে বিনয়ের সহিত ব্যবহার করুন,সিভি দিন। সমসময় তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করুন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে তাঁদের প্রতিষ্ঠানে আপনি নিয়োগ পেতে পারেন।
চাকুরির আবেদনের জন্য আলাদা ইমেইল একাউন্ট ব্যবহার করুন
চাকুরির আবেদনের জন্য একটি আলাদা ইমেইল একাউন্ট তৈরি করুন এবং ব্যবহার করুন। উক্ত ইমেইলটি সিভিতে উল্ল্যেখ করুন। চাকরি খোঁজা ছাড়া অন্য কোন কাজে এই ইমেইল ব্যবহার করবেন না। আজকাল বেশীরভাগ চাকরির জন্য ইমেইলে-ই এর মাধ্যমেই যোগাযোগ করা হয়। অনেক ঘটনা দেখা যায়, সব জায়গায় একই ইমেইল ব্যবহার করার ফলে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় ইমেইল এর ভিড়ে আপনার প্রয়োজনীয় ইমেইল আপনি খেয়ালই করেন নি। আপনার ইন্টারভিউ অথবা ভাইবা মিস হয়ে যেতে পারে এর ফলে।
আড়াল থেকে নিজেকে বের করুন এবং নিজেকে মেলে ধরুন
বেসরকারি প্রতিষ্টানে সিভি জমা দিয়ে চাকরি দাতার যোগাযোগের অপেক্ষায় বসে থাকবেন না। নিজে প্রতিষ্ঠানে গিয়ে মাঝে মধ্যে খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করুন। উক্ত প্রতিষ্ঠানে আপনার পরিচিত কেউ থাকলে কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করুন,নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করুন। যদি এই চাকরির জন্য নিজেকে যোগ্য মনে করেন কিংবা প্রমান করতে সক্ষম হন,তাহলে উক্ত ব্যক্তি চাকরিটি পাওয়ার অনুরোধ করতে পারেন সরাসরি। এই ক্ষেত্রে আপনার অযোগ্য হওয়ার কোন ভয় নেই, বরং আপনার সাহস আরো বাড়বে, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আপনি আরো দক্ষ হবেন। এতে আপনার আত্মবিশ্বাসই কর্তৃপক্ষকে বিশ্বাসী করে তুলতে পারে। মনে রাখবেন নিজেকে মেলে ধরাও আপনার একটি বাড়তি যোগ্যতা।
ইন্টারভিউকে ভয় পাবেন না বরং সাহসের সাথে মোকাবেলা করুন
প্রতিষ্ঠান যেমনই হোক,ঘাবড়ে যাবেন না কখনোই। ইন্টারভিউয়ে বসে নিজেকে খোলাখুলি উপস্থাপন করুন। আপনি কি পারেন,কি কি চ্যালেঞ্জে কি কি উপায়ে মোকাবিলা করতে পারবেন,সবকিছু সহজ ভাষায় ভালোভাবে উপস্থাপন করুন। তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলুন কারন এটা আপনার আত্নবিশ্বাস কে উপস্থাপন করবে। সকল প্রশ্নের উত্তর আপনি দিতে পারবেন এমন টা নাও হতে পারে, কোন কিছু না পারলে সুন্দরভাবে না করুন। কনফ্লিক্ট হতে পারে এমন উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। উত্তর সরাসরি প্রদান করার চেষ্টা করুন।
সবসময় ডায়েরী মেইন্টেন করুন
সবসময় একটি সাধারন ডায়েরী মেইন্টেন করুন। আপনি কোথায় কোথায় আবেদন করেছেন,কি কি পদে আবেদন করেছেন তা উক্ত ডায়েরীতে লিখে রাখুন। নিজের সকল যোগ্যতার কাগজপত্রও হাতের কাছে গুছিয়ে প্রস্তুত রাখুন। যখন যেখানে ডাক পাবেন, সময় নষ্ট না করে নিজেকে তৈরি রাখুন,সবসময় আত্মবিশ্বাসী হোন।
যদি আপনার কোন অভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে করণীয়
কোন কোন প্রতিষ্ঠান নতুন কাউকে শিক্ষানবিস হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকে। যদি আপনার কোন অভিজ্ঞতা নাও থাকে তবুও এইসব প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করুন। ছয় মাস/ এক বছর শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করে প্রাথমিক দায়িত্ব নিজ দায়িত্বে আয়ত্ত করে নিন,নিজের যোগ্যতা প্রমান করুন কিংবা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে প্রয়োজনে পরবর্তীতে অন্যত্র কাজে সন্ধান করুন। স্থায়ীত্ব পাওয়ার আশায় সে প্রতিষ্ঠানে সময় নষ্ট করবেন না। সামাজিক কাজ কর্মে নিজেকে নিয়োজিত রাখুন। সামাজিক কাজ গুলো চাকরি দাতার নিকট অনেক সময় অভিজ্ঞতা হিসেবে গন্য হয়। তাছাড়া দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিদেশী ভাষা শিক্ষা,কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে বিনামুল্যে কিংবা নামমাত্র খরচে এই প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। মনে রাখবেন এই সব খরচ আপনার জন্য সর্বোত্তম বিনিয়োগ।
পরিচিত রেফারেন্স ব্যবহার করুন
রেফারেন্স একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই সিভিতে পরিচিতজনদের মধ্যে বড় পদাধিকারী কেউ থাকলে তার রেফারেন্স দিন। যারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়েছেন,তারা শিক্ষকদেরকে রেফারেন্স হিসেবে দেখাতে পারেন। এটি চাকরি পাওয়ার জন্য দারুণ কাজে দেয়। তা ছাড়া চাকরিদাতারও আস্থা অর্জন করা যায়। যাকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করবেন,তার নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে নেবেন এবং চাকরির আবেদন সম্পর্কে নিয়মিত আপডেট দিবেন। তাকে আপনি অবহিত না করলে এবং পরবর্তীতে নিয়োগকর্তা উক্ত ব্যক্তিতে আপনার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বিব্রত হতে পারেন এবং আপনাকে চিনেন/ জানেন না বলে উত্তর দিতে পারেন।
একধাপ এগিয়ে থাকুন
কখনো থামবেন না। চাকরির খুঁজে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হবেন না। যেসব প্রতিষ্ঠানে সিভি জমা দিয়েছেন সেসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত খোঁজ রাখুন। যদি চাকরি করার বাসনা থাকে,শিক্ষাজীবন থেকে চাকরি যুদ্ধে লড়াই এর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে অন্যের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকুন। মনে রাখবেন এগিয়ে থাকার কোন বিকল্প নাই।