ভূমি আইন ২০২৫

ওয়ারিশ, দখল ও মালিকানা ২০২৫ । নতুন আইনে চলতি বছরের মধ্যে যাদের জমি তারা পাবেন?

সূচীপত্র

বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনায় এক বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে, যার লক্ষ্য হলো ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা কমানো, জালিয়াতি প্রতিরোধ করা এবং প্রকৃত মালিকদের কাছে তাদের হারানো জমি ফিরিয়ে দিতে কিছু কার্যকর নতুন ভূমি আইন এবং ভূমি সংস্কারের অংশ হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে – ওয়ারিশ, দখল ও মালিকানা ২০২৫

এওয়াজ বদল দলিল (Exchange Deed) বাতিল হবে?  কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার ওয়ারিশদের মধ্যে জমি বন্টন না করে, কোনো ওয়ারিশ বা অন্য কেউ সম্পূর্ণ বা আংশিক জমি অন্যের সঙ্গে ‘এওয়াজ বদল’ বা বিনিময়ের মাধ্যমে দলিল করে ফেলে। এক্ষেত্রে প্রকৃত ওয়ারিশরা তাদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হন। নতুন আইনে, যদি প্রমাণিত হয় যে মৃত ব্যক্তির জমি ওয়ারিশদের ন্যায্য অংশ বুঝিয়ে না দিয়ে এই ধরনের দলিল করা হয়েছে, তবে সেই দলিল বাতিল বলে গণ্য হবে এবং ওয়ারিশরা তাদের অংশ বুঝে পাবেন। এবং জার উদ্দেশ্য হলো উত্তরাধিকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এলিয়াতি করে পৈত্রিক সম্পত্তি আত্মসাৎ বন্ধ করা হবে।

অবৈধভাবে দখলকৃত সরকারি খাস জমি পুনরুদ্ধার হবে? সরকারি খাস জমি হলো রাষ্ট্রের মালিকানাধীন ভূমি, যা সাধারণত ভূমিহীন ও অসচ্ছল ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণের জন্য নির্ধারিত। তবে, দীর্ঘদিন ধরে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোনো প্রকার বৈধ লিজ বা বন্দোবস্ত ছাড়াই এই খাস জমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। নতুন ভূমি আইনের অধীনে, এই অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সরকার এসব খাস জমি চিহ্নিত করে দখলমুক্ত করবে এবং প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করবে, যা গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে সহায়ক হবে।

জবরদখলকৃত জমি প্রকৃত মালিকদের কাছে ফেরত পাবে? অনেক সময় ক্ষমতা, প্রভাব, ভয়ভীতি প্রদর্শন, কিংবা প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে অন্যের জমি জবরদখল করা হয়। দুর্বল বা প্রান্তিক মানুষের জমি জোরপূর্বক দখল করার ঘটনাও অহরহ ঘটে। নতুন আইনে, এই ধরনের জবরদখলকৃত জমি চিহ্নিত করা এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এটি ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে এবং সমাজে ভূমি সংক্রান্ত অপরাধ হ্রাস করতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশে ২০২৪-২০২৫ সালে নতুন কোনো উত্তরাধিকার আইন বা ওয়ারিশ আইন প্রণীত হয়নি। তবে, ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ কার্যকর হওয়ায় জমির দখল, মালিকানা ও ওয়ারিশ সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে পরিবর্তন এসেছে। এই আইনের মূল লক্ষ্য হলো ভূমি সংক্রান্ত জালিয়াতি ও প্রতারণা রোধ করে প্রকৃত মালিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে

জাল দলিলের জমি বাতিল হবে? ভূমি সংক্রান্ত জালিয়াতির অন্যতম প্রধান উপায় হলো জাল দলিল তৈরি করা। অসৎ ব্যক্তিরা জাল স্বাক্ষর, মিথ্যা তথ্য, বা সরকারি রেকর্ড জালিয়াতি করে ভুয়া দলিল তৈরি করে প্রকৃত মালিকের সম্পত্তি আত্মসাৎ করে। নতুন ভূমি ব্যবস্থাপনায়, জমির সকল দলিল স্ক্যান করে অনলাইনে সংরক্ষণ করা হচ্ছে এবং দলিলের সত্যতা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা হচ্ছে। এর ফলে, জাল দলিল সহজে শনাক্ত করা যাবে এবং এমন দলিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল বলে গণ্য হবে, যার ফলে প্রকৃত মালিক তার হারানো জমি ফিরে পাবেন।

Caption: land office

হেবা বা দানের নতুন কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। বাংলাদেশে মুসলিম আইনে হেবা বা দান সম্পর্কিত প্রচলিত নিয়মকানুনগুলোই সাধারণত অনুসরণ করা হয়। হেবার প্রধান শর্ত হলো, এটি কোনো প্রকার প্রতিদান বা বিনিময় ছাড়া হতে হবে এবং এটি অবশ্যই তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে।

  1. একাধিক ওয়ারিশের জমি একক ওয়ারিশের সাব-কবলা দলিল বাতিল: অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি পৈত্রিক সম্পত্তির একাধিক ওয়ারিশ থাকা সত্ত্বেও, একজন ওয়ারিশ অন্যদের অগোচরে বা অনুমতি ছাড়াই সম্পূর্ণ জমি বা তার নিজের অংশ ছাড়া অন্যদের অংশও সাব-কবলা (বিক্রয়) দলিল করে দেন। এটি উত্তরাধিকার আইন ও ভূমি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। নতুন নিয়মে, যদি প্রমাণিত হয় যে সকল ওয়ারিশের সম্মতি ব্যতীত এই ধরনের দলিল করা হয়েছে, তবে তা বাতিল বলে বিবেচিত হবে। এর ফলে বাকি ওয়ারিশরা তাদের ন্যায্য হিস্যা রক্ষা করতে পারবেন।
  2. দুর্নীতির মাধ্যমে করা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল বাতিল: সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে ভূমি নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় একসময় দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ছিল। ঘুষ বা অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে অনেক সময় বেআইনি বা ত্রুটিপূর্ণ দলিল নিবন্ধন করা হতো। নতুন ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যদি তদন্তে প্রমাণিত হয় যে কোনো দলিল ঘুষ বা অন্য কোনো অবৈধ উপায়ে নিবন্ধন করা হয়েছে, তবে সেই দলিল বাতিল বলে গণ্য হতে পারে। এটি ভূমি নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে আরও নির্ভরযোগ্য করে তুলবে।
  3. খাস খতিয়ানের সম্পত্তি ব্যক্তিগত নামে বিক্রি বাতিল: খাস খতিয়ানভুক্ত সম্পত্তি সাধারণত সরকারি বা জনস্বার্থে ব্যবহৃত ভূমি। তবে, কিছু অসাধু ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত জমিকে এসএ (স্টেট অ্যাকুইজিশন) বা আরএস (রিভিশনাল সার্ভে) খতিয়ানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ড করে বিক্রি করে দেন। এই ধরনের লেনদেন সম্পূর্ণ অবৈধ। নতুন আইনে, এই ধরনের প্রতারণামূলক দলিল বাতিল করা হবে এবং জমি পুনরায় সরকারি খাস খতিয়ানে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
  4. রক্তসম্পর্কের ১৪ শ্রেণির বাইরে হেবা (দানপত্র) দলিল বাতিল: ইসলামী আইন অনুযায়ী ‘হেবা’ বা দানপত্র দলিলের কিছু নির্দিষ্ট নিয়মকানুন আছে, বিশেষত রক্তসম্পর্কের ভিত্তিতে। নতুন ভূমি আইন অনুযায়ী, যদি রক্তসম্পর্কের ১৪টি নির্দিষ্ট শ্রেণির বাইরের কাউকে হেবা দলিল করা হয়, তবে তা অকার্যকর বা বাতিল বলে ঘোষণা করা হতে পারে। এর উদ্দেশ্য হলো হেবা দলিলের অপব্যবহার রোধ করা, যেমন কর ফাঁকি দেওয়া বা নিয়ম বহির্ভূতভাবে সম্পত্তি হস্তান্তর করা। প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো, দান যেন প্রকৃত ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি অনুযায়ী হয়।

ওসিয়ত (উইল) দলিলের সীমাবদ্ধতা থাকবে না?

ইসলামী উত্তরাধিকার আইন (ফারায়েজ) অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি তার মোট সম্পত্তির সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত ওসিয়ত বা উইল করতে পারেন। তবে, এই ওসিয়ত তার আইনি ওয়ারিশদের জন্য করা যায় না, বরং ওয়ারিশদের বাইরে অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য করা হয়। নতুন নিয়মে, যদি কোনো ওসিয়ত এই এক-তৃতীয়াংশের সীমা অতিক্রম করে অথবা ওয়ারিশদের বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে নিজ পরিবার বা ওয়ারিশদের মধ্যে করা হয়, তবে সেই ওসিয়ত দলিল বাতিল বলে গণ্য হবে। এর উদ্দেশ্য হলো উত্তরাধিকার আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং ওয়ারিশদের অধিকার রক্ষা করা হবে। এই সকল পদক্ষেপ বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনাকে আরও সুসংহত, স্বচ্ছ এবং জনমুখী করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জাল দলিল: জালিয়াতি করে তৈরি করা দলিলের মাধ্যমে যদি কেউ কোনো জমি দখল করে থাকে।বণ্টননামা ছাড়া: ওয়ারিশদের মধ্যে যথাযথ বণ্টননামা দলিল না করে যদি কোনো এক শরিক অন্যের অংশ বিক্রি করে থাকে।ভুল খতিয়ান: যেখানে জমি এক খতিয়ানে থাকা সত্ত্বেও অন্য খতিয়ানে ভুলবশত অন্যের নামে রেকর্ড করা হয়েছে।
হেবা দলিলের ত্রুটি: যদি হেবা দলিলের শর্ত যথাযথভাবে মানা না হয়, যেমন: নির্ধারিত অংশের চেয়ে বেশি জমি দান করা।জবরদখল: ক্ষমতার অপব্যবহার বা ভয়ভীতি দেখিয়ে কোনো জমি জবরদখল করা হলে।পরিত্যক্ত সম্পত্তি: দেশ ত্যাগ করা কোনো ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি (Evacuee Property) যদি কেউ অবৈধভাবে দখল করে রাখে।
   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *