খতিয়ান ও অনলাইন ই পর্চা

ভূমি জরিপের ইতিহাস ২০২৫ । খতিয়ানের বিবর্তন ও গুরুত্ব কি?

বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি হলো ‘খতিয়ান’ বা স্বত্বের রেকর্ড। সময়ের সাথে সাথে ভূমি জরিপের পদ্ধতি ও নামকরণের পরিবর্তন হয়েছে, যা দেশের ভূমি রেকর্ডের ঐতিহাসিক বিবর্তনকে তুলে ধরে। সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যাদি অনুযায়ী, প্রধানত চারটি ধাপে এই খতিয়ানগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে, যা দেশের ভূমি মালিকানা সংক্রান্ত আইনি দলিলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

খতিয়ানের প্রধান ধাপসমূহ

ভূমি জরিপের ইতিহাসে চারটি প্রধান ধাপ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:

খতিয়ানের ধরনপুরো নামসময়কালআমলে তৈরিঅতিরিক্ত পরিচিতি
CSCadastral Survey (ভূমি জরিপ)১৮৮৮-১৯৪০ব্রিটিশ আমলDS (ঢাকা সার্ভে) নামেও পরিচিত। এটিই ছিল প্রথম জরিপ।
SAState Aquisition (রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ)১৯৫৬-১৯৬৩পাকিস্তান আমলPS (পাকিস্তান সার্ভে) এবং MR (মুদ্রিত রেকর্ড) নামেও পরিচিত।
RSRevisional Survey (সংশোধনী জরিপ)১৯৬৬-১৯৮৪বাংলাদেশ/পাকিস্তান আমলSA খতিয়ানের ভুল ও ত্রুটি সংশোধনের জন্য এই জরিপ করা হয়।
BSBangladesh Survey (বাংলাদেশ জরিপ)১৯৮৪-চলমানবাংলাদেশ আমলCity Jourips (সিটি জরিপ) এর ক্ষেত্রে RS এবং BS উভয়ই বাংলাদেশে তৈরি।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

  • CS খতিয়ান (১৮৮৮-১৯৪০): এটিই ছিল উপমহাদেশের প্রথম ভূমি জরিপ। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই খতিয়ান আজও বহু পুরোনো মালিকানার ক্ষেত্রে মৌলিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।

  • SA খতিয়ান (১৯৫৬-১৯৬৩): এই জরিপটি পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ কার্যকর হওয়ার পর তৈরি হয়। এর মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয় এবং সরকারের সাথে সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হয়।

  • RS ও BS খতিয়ান (১৯৬৬-বর্তমান): এই দুটি জরিপই মূলত স্বাধীন বাংলাদেশে ভূমি সংক্রান্ত রেকর্ড আধুনিকায়ন ও ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা। RS খতিয়ান তৈরি হয়েছিল মূলত SA খতিয়ানের ভুলগুলো সংশোধন করার জন্য। বর্তমানে BS (বাংলাদেশ জরিপ) বা সিটি জরিপ চলমান রয়েছে, যার লক্ষ্য হলো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্ভুল ভূমি রেকর্ড তৈরি করা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমি সংক্রান্ত কোনো আইনি জটিলতা নিরসনে, এই চারটি খতিয়ানের ক্রমিক বিবর্তন ও তাদের আইনি ভিত্তি বোঝা অপরিহার্য। প্রতিটি খতিয়ানই সংশ্লিষ্ট সময়ের ভূমি ব্যবস্থাপনার চিত্র বহন করে।

বাংলাদেশের ভূমি আইনে প্রতিটি খতিয়ানের আলাদা আলাদা তাৎপর্য রয়েছে, যা ভূমির মালিকানা প্রমাণ ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে অপরিহার্য।

১. CS খতিয়ান (Cadastral Survey) – (১৮৮৮-১৯৪০)

CS = Cadastral Survey

  • আইনি তাৎপর্য: এটি হলো মৌলিক খতিয়ান (Original Record of Rights)। এটি ব্রিটিশ আমলে তৈরি এবং এটিই দেশের প্রথম সম্পূর্ণ ভূমি রেকর্ড।

  • ব্যবহারের ক্ষেত্র:

    • ভূমি সংক্রান্ত পুরোনো বিরোধ নিষ্পত্তিতে CS খতিয়ানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়, বিশেষ করে যদি বিরোধটি জমির আদি বা মূল মালিকানা নিয়ে হয়।

    • পরবর্তী কোনো খতিয়ানে ভুল ধরা পড়লে, সেই ভুল সংশোধনের জন্য এটি ভিত্তি দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

    • আদি রেকর্ডের সঙ্গে পরবর্তী রেকর্ডের ধারাবাহিকতা প্রমাণের জন্য এটি অপরিহার্য।

২. SA খতিয়ান (State Acquisition) – (১৯৫৬-১৯৬৩)

SA = State Acquisition

  • আইনি তাৎপর্য: এই খতিয়ানটি জমিদারি প্রথা বিলোপের পর তৈরি হয়। ১৯৫০ সালের “রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন” কার্যকর হওয়ার পর এটি প্রস্তুত করা হয়। এটি প্রমাণ করে যে জমিদারি প্রথা থেকে সরকার জমি অধিগ্রহণ করেছে এবং প্রজা (রায়ত)-কে সরাসরি মালিকানা দিয়েছে।

  • ব্যবহারের ক্ষেত্র:

    • এই খতিয়ান প্রমাণ করে যে জমিদারি প্রথার পর প্রথম রেকর্ডীয় মালিক কে ছিলেন।

    • ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) পরিশোধের ভিত্তি হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়।

    • অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পুরনো দলিলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি দলিল।

৩. RS খতিয়ান (Revisional Survey) – (১৯৬৬-১৯৮৪)

RS = Revisional Survey

  • আইনি তাৎপর্য: RS খতিয়ানকে বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খতিয়ান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি তৈরি করা হয়েছিল SA খতিয়ানের বিভিন্ন ভুল ও ত্রুটি সংশোধন করার জন্য। বাস্তবে, দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে এটিই সর্বশেষ প্রকাশিত স্বত্বলিপি (Latest Published Record of Rights)।

  • ব্যবহারের ক্ষেত্র:

    • ভূমি হস্তান্তর (বিক্রি, দান, বিনিময়) এবং ঋণ গ্রহণের সময় ব্যাংক ও ক্রেতারা সাধারণত RS খতিয়ানকেই প্রধান দলিল হিসেবে দেখতে চায়।

    • অধিকাংশ ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে, বিশেষ করে বর্তমানে দখল ও মালিকানা প্রমাণের জন্য, RS খতিয়ানই প্রাথমিক দলিল হিসেবে আদালতে উপস্থাপিত হয়।

    • এর ভিত্তিতেই সাধারণত নামজারি (মিউটেশন) এবং জমাভাগ সম্পন্ন হয়।

৪. BS খতিয়ান (Bangladesh Survey) – (১৯৮৪-চলমান)

BS = Bangladesh Survey

  • আইনি তাৎপর্য: এটিই বাংলাদেশের সর্বাধুনিক এবং চলমান জরিপ। এর মূল লক্ষ্য হলো আধুনিক প্রযুক্তি (যেমন জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম – GIS) ব্যবহার করে নির্ভুল ভূমি রেকর্ড তৈরি করা। এটিকে সিটি জরিপ বা ঢাকা মহানগর জরিপ নামেও পরিচিত।

  • ব্যবহারের ক্ষেত্র:

    • যেসব এলাকায় এই জরিপ চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে এটিই সর্বশেষ ও চূড়ান্ত রেকর্ড হিসেবে গণ্য হয় এবং এটি RS খতিয়ানের স্থান নেয়।

    • শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন এলাকাগুলোতে, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

    • সম্পূর্ণ নির্ভুল হওয়ায় এটি ভবিষ্যতে ভূমি বিরোধ অনেকাংশে কমিয়ে দেবে বলে আশা করা হয়।


সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ

খতিয়ানমূল কাজ (আইনি ভূমিকা)বর্তমান আইনি অবস্থান
CSআদি বা মূল মালিকানা প্রমাণ করা।পুরোনো বিরোধে ভিত্তি দলিল।
SAজমিদারি বিলোপের পর মালিকানা নির্ধারণ।SA এর ভুল সংশোধিত হয়েছে RS দ্বারা।
RSSA এর ভুল সংশোধন এবং সর্বশেষ মালিকানা নিশ্চিত করা।বর্তমানে সর্বাধিক ব্যবহৃত ও গুরুত্বপূর্ণ আইনি দলিল।
BSআধুনিক প্রযুক্তিতে সম্পূর্ণ নির্ভুল রেকর্ড তৈরি।যেখানে প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে এটিই চূড়ান্ত রেকর্ড

আইনগতভাবে, ভূমি মালিককে অবশ্যই সর্বশেষ প্রকাশিত খতিয়ানের ভিত্তিতে তার মালিকানা প্রমাণ করতে হবে। তবে, যেকোনো বিরোধে আদালত CS থেকে শুরু করে সর্বশেষ খতিয়ান পর্যন্ত সবগুলোর ধারাবাহিকতা এবং যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে রায় প্রদান করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *