ভূমি আইন ২০২৫

দলিল ও দখল আছে, কিন্তু রেকর্ড নেই জেনে নিন আইনি সমাধান ও করণীয় কি?

বাংলাদেশে জমি নিয়ে বিরোধ ও মামলার অন্যতম প্রধান কারণ হলো মালিকানা সংক্রান্ত কাগজপত্রের অসঙ্গতি। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়—হাতে রেজিস্ট্রিকৃত দলিল আছে, জমিতে নিজের দখলও আছে, কিন্তু সরকারি রেকর্ডে (খতিয়ানে) নিজের নাম নেই। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি স্বাভাবিক মনে হলেও, দীর্ঘমেয়াদে এটি জমির মালিকানার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ হতে পারে।

আইনজ্ঞদের মতে, দলিল ও দখল থাকাটা আইনি লড়াইয়ের জন্য শক্তিশালী ভিত্তি, তবে রেকর্ড বা খতিয়ানে নাম না থাকাটা মালিকানার প্রমাণে বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এই প্রতিবেদনে আমরা জানাবো, এমন পরিস্থিতিতে আপনার অবস্থান কতটা শক্তিশালী এবং রেকর্ড সংশোধনে আপনার করণীয় কী।

বর্তমান আইনি অবস্থান: শক্তি বনাম ঝুঁকি

কোনো ব্যক্তির যদি রেজিস্ট্রিকৃত দলিল (যেমন সাফ-কবলা বা হেবা দলিল) থাকে এবং তিনি যদি বাস্তবে ওই জমি ভোগদখল করেন, তবে আইনত তিনি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন। দলিল হলো মালিকানার মূল ভিত্তি, আর দখল প্রমাণ করে যে জমিটি আপনার নিয়ন্ত্রণে আছে। আদালত সূত্রে জানা যায়, দলিল ও দখল ঠিক থাকলে মালিকানা প্রমাণের সম্ভাবনা প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ

তবে, বিপত্তি ঘটে যখন সরকারি খতিয়ানে (CS, SA, RS বা BS) মালিক হিসেবে আপনার নাম থাকে না। সরকারি রেকর্ডে নাম না থাকলে খাজনা দেওয়া, জমি বিক্রি করা বা ঋণ নেওয়া জটিল হয়ে পড়ে। এমনকি ভবিষ্যতে অন্য কেউ ভুয়া রেকর্ডের ভিত্তিতে আপনার জমির মালিকানা দাবি করলে আপনাকে আইনি হয়রানির শিকার হতে হতে পারে।

রেকর্ড সংশোধনে করণীয় ৫টি ধাপ

আইন বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, দলিল ও দখল থাকার পরেও যদি রেকর্ড না থাকে, তবে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে নিচের ৫টি ধাপ অনুসরণ করা জরুরি:

১. খতিয়ান যাচাই: সর্বপ্রথম নিশ্চিত হতে হবে কোন খতিয়ানে (CS, SA, RS বা BS) আপনার নাম নেই। এজন্য জেলা রেকর্ড রুম বা land.gov.bd ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে যাচাই করতে হবে।

২. দখলের প্রমাণ প্রস্তুত: আদালতে বা ভূমি অফিসে নিজের অবস্থান শক্ত করতে দখলের প্রমাণ জোগাড় করা অত্যাবশ্যক। জমিতে ঘরবাড়ি, গাছপালা, চাষাবাদ, ভাড়া আদায়ের রসিদ বা খাজনার রসিদ এবং স্থানীয়দের সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগে।

৩. নামজারি (Mutation) আবেদন: ইউনিয়ন বা উপজেলা ভূমি অফিসে দলিল ও দখলের প্রমাণসহ নামজারির আবেদন করতে হবে। অনেক সময় নামজারি বা মিউটেশনের মাধ্যমেই রেকর্ডের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয়। প্রয়োজনে আরএস (RS) বা বিএস (BS) সংশোধনের আবেদনও করতে হতে পারে।

৪. রেকর্ড সংশোধনের মামলা: যদি ভূমি অফিস (AC Land) নামজারির আবেদন খারিজ করে দেয়, তবে তার বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে। সেখানেও সমাধান না হলে দেওয়ানি আদালতে খতিয়ান সংশোধনের বা ঘোষণামূলক মামলা দায়ের করতে হবে। ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল বা দেওয়ানি আদালত দলিল ও প্রমাণের ভিত্তিতে রায় প্রদান করে।

৫. আদালতের রায় বাস্তবায়ন: আদালত যদি আপনার পক্ষে রায় দেয়, তবে সেই রায়ের সার্টিফাইড কপি নিয়ে পুনরায় ভূমি অফিসে যোগাযোগ করতে হবে এবং সরকারি রেকর্ড বা খতিয়ান সংশোধন করে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

রেকর্ড সংশোধনের জন্য আবেদন বা মামলার ক্ষেত্রে নিচের কাগজপত্রগুলো হাতের কাছে রাখা জরুরি:

  • মূল দলিলের কপি (রেজিস্ট্রেশন নম্বরসহ)।

  • দখলের প্রমাণপত্র (ছবি, চাষাবাদের প্রমাণ, ইউটিলিটি বিল ইত্যাদি)।

  • হালনাগাদ খাজনার রসিদ (যদি থাকে)।

  • জাতীয় পরিচয়পত্র (NID)।

  • সংশ্লিষ্ট খতিয়ানের কপি (CS/SA/RS/BS)।

  • ওয়ারিশ সনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)।

শেষ কথা

“দলিল আছে, দখল আছে”—এই ভেবে নিশ্চিন্ত থাকার সুযোগ নেই। সরকারি রেকর্ডে নাম না থাকাটা ভবিষ্যতের জন্য একটি ‘টাইম বোমা’র মতো। তাই জটিলতা এড়াতে দ্রুত নামজারি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা এবং প্রয়োজনে আইনি সহায়তা নিয়ে রেকর্ড সংশোধন করা প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব।

জমি নামজারি করতে কত টাকা খরচ হয়?

নামজারি (Mutation) করতে সরকারি ফি নির্ধারিত আছে এবং এর বাইরে কিছু আনুষঙ্গিক খরচও হতে পারে। সরকারি ফি সাধারণত খুব বেশি হয় না, কিন্তু প্রক্রিয়া চলাকালীন কিছু অতিরিক্ত খরচ লাগতে পারে।

সাধারণত, নামজারি করতে যে খরচগুলো হয়, সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো:

  1. আবেদন ফি (Application Fee):

    • এটি সাধারণত ৫০ টাকা। অনলাইনে আবেদন করার সময় এই ফি পরিশোধ করতে হয়।

  2. নোটিশ জারি ফি (Notice Issuance Fee):

    • এটি সাধারণত ৫০ টাকা। আবেদন করার পর সংশ্লিষ্ট পক্ষদের নোটিশ পাঠানোর জন্য এই ফি নেওয়া হয়।

  3. রেকর্ড সংশোধন ফি (Record Correction Fee) / খতিয়ান ফি:

    • নামজারি সম্পন্ন হওয়ার পর নতুন খতিয়ান তৈরির জন্য এই ফি নেওয়া হয়। এটি সাধারণত ১০০০ টাকা

  4. কোর্ট ফি (Court Fee):

    • আবেদনের সাথে ২০ টাকা মূল্যের একটি কোর্ট ফি সংযুক্ত করতে হয়।

মোট সরকারি ফি: ৫০ + ৫০ + ১০০০ + ২০ = ১১২০ টাকা

আনুষঙ্গিক খরচ (যা স্থানভেদে ভিন্ন হতে পারে):

  • দলিল ও অন্যান্য কাগজপত্রের ফটোকপি/সত্যায়িত কপি: আবেদনের সাথে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ফটোকপি জমা দিতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে এগুলো সত্যায়িত করার প্রয়োজন হতে পারে, যার জন্য সামান্য খরচ হয়।

  • অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়া ফি (যদি নিজে না করেন): যদি আপনি কোনো কম্পিউটার দোকান বা এজেন্টের মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন করেন, তাহলে তারা একটি সার্ভিস চার্জ নিতে পারে, যা সাধারণত ১০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

  • যাতায়াত খরচ: ভূমি অফিসে যাওয়া-আসার জন্য যাতায়াত খরচ লাগতে পারে।

  • অন্যান্য (অপ্রত্যাশিত): কিছু ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিলে বা সরেজমিন তদন্তের জন্য কিছু অতিরিক্ত খরচ হতে পারে, যা সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:

  • ভূমি অফিসের নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি ফির বাইরে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা অবৈধ। যদি কেউ অতিরিক্ত টাকা দাবি করে, তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।

  • সব ফি সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয় এবং এর রশিদ সংরক্ষণ করা উচিত।

  • অনলাইনে নামজারির আবেদন করলে ফি পরিশোধের প্রক্রিয়া সহজ হয় এবং অনেক হয়রানি এড়ানো যায়।

সুতরাং, নামজারি করতে আপনার মোট সরকারি খরচ হবে ১১২০ টাকা, এর বাইরে আনুষঙ্গিক কিছু খরচ থাকতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *