ভূমি আইন ২০২৫

উত্তরাধিকার সম্পত্তি সুরক্ষায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৪ যুগান্তকারী নিয়ম কার্যকর ২০২৫ । বন্ধ হচ্ছে বঞ্চনা, দখল ও গোপন বিক্রি

সূচীপত্র

ঢাকা, ২১ নভেম্বর ২০২৫ — দেশের দীর্ঘদিনের জটিল ও দুর্বোধ্য উত্তরাধিকার সম্পত্তি ভাগাভাগির প্রক্রিয়ায় অবশেষে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ভূমি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আজ থেকে (২০২৫ সাল) সারাদেশে একযোগে চারটি যুগোপযোগী নিয়ম কার্যকর হয়েছে। এর মাধ্যমে আর কেউ সহজে পৈত্রিক সম্পত্তি দখল, বঞ্চনা বা গোপনে বিক্রি করতে পারবে না। মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে—এই নিয়মগুলো কার্যকর হলে উত্তরাধিকার নিয়ে বছরের পর বছর চলা বিরোধ, দখল, প্রতারণা ও মামলা ব্যাপকভাবে কমে আসবে এবং পরিবারে শান্তি ফিরবে।

হাজার হাজার পরিবারে ভাই-বোনকে জমি না দেওয়া, গোপনে রেকর্ড করে নেওয়া বা এতিম সন্তানকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার মতো সামাজিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান দেবে এই নতুন আইনগুলো।


৪টি মূল নিয়মে আসছে বড় পরিবর্তন

ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক কার্যকর করা প্রধান চারটি নিয়ম নিচে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:

১. বঞ্চনা নিষিদ্ধ: এতিম সন্তানেরা পাবে বাবার পূর্ণ অধিকার

নতুন আইনে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে প্রকৃত কোনো ওয়ারিশকে বঞ্চিত করাকে সরাসরি দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

  • এতিমের অধিকার: এখন থেকে একজন ছেলে মারা গেলে, তার জীবিত ছেলেমেয়েরা (নাতি-নাতনি) দাদার সম্পত্তিতে বাবার অংশ পূর্ণ উত্তরাধিকার হিসেবে পাবে। এটি মুসলিম পারিবারিক আইন, ১৯৬১-এর কঠোর বাস্তবায়ন।

  • শাস্তি: যদি কারও প্রাপ্য সম্পত্তি গোপনে কেড়ে নেওয়া হয়, তবে আদালতে মামলা করলে সম্পত্তি ফেরত তো মিলবেই, সেই সঙ্গে দোষী ওয়ারিশের ৭ বছর কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা হবে।

২. যৌথ খতিয়ান বাধ্যতামূলক: গোপন নামজারি বন্ধ

পূর্বে অনেকেই গোপনে নামজারি করে নিজেদের নামে পুরো সম্পত্তি রেকর্ড করে বিক্রি করে দিত। নতুন নিয়মে সেই পথ বন্ধ করা হয়েছে।

  • যৌথ প্রক্রিয়া: এখন থেকে সব ওয়ারিশকে নিয়ে একটি যৌথ ওয়ারিশ সনদ তৈরি করতে হবে এবং যৌথভাবে নামজারি করতে হবে।

  • স্বচ্ছতা: সবার নামে একটি যৌথ খতিয়ান তৈরি হবে, যেখানে প্রত্যেকে কোন দাগে কতটুকু অংশ পাচ্ছেন—তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। এর ফলে আর কেউ গোপনে বেশি জমি নিজের নামে করে নিতে বা এককভাবে বিক্রি করতে পারবে না।

৩. দখল বা রেকর্ড করলেই মালিক নয়: অধিকার থাকবে অটুট

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কেউ বহু বছর দখলে রেখে বা নিজের নামে রেকর্ড করেও অন্য ভাই-বোনদের বঞ্চিত করে রেখেছে। এই ধরনের প্রতারণা রুখতে নতুন আইনে বলা হয়েছে:

  • অধিকার অটুট: ১০০ বছর দখল থাকলেও প্রকৃত ওয়ারিশের অধিকার বাতিল হবে না।

  • সহজ প্রতিকার: অন্য ওয়ারিশ চাইলে এখন সহজেই রেকর্ড সংশোধনের মাধ্যমে জমি ফেরত পাবেন এবং আদালত প্রতারিত ওয়ারিশের পক্ষেই রায় দেবে। অর্থাৎ, কেবল রেকর্ড বা দখল করলেই জমির মালিক হওয়া যাবে—এই ধারণা এখন বাতিল।

৪. প্রি-এমশন আরও কঠোর: গোপনে সম্পত্তি বিক্রি নিষিদ্ধ

নতুন নিয়মে ওয়ারিশদের না জানিয়ে উত্তরাধিকার সম্পত্তি বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

  • বিক্রি করলে ফেরত: যদি কেউ গোপনে সম্পত্তি বিক্রি করে, তবে অন্য ওয়ারিশরা আদালতে প্রি-এমশন মামলা (অগ্রক্রয়) দিয়ে সেই জমি ফেরত পাবে।

  • ক্রেতার ঝুঁকি: এক্ষেত্রে ক্রেতাকে দলিলে উল্লেখিত দাম অনুযায়ী টাকা ফেরত দেওয়া হবে। দলিলে কম মূল্য দেখিয়ে ট্যাক্স ফাঁকি দিলে সেই ঝুঁকি ক্রেতার ওপরেই বর্তাবে।


️ স্থায়ী সমাধানের পথ দেখছে সরকার

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জানিয়েছে, এই চারটি নিয়ম উত্তরাধিকার সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় একটি স্থায়ী সমাধান এনে দেবে। ভূমি মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে, এই নিয়মগুলো এখন থেকে দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও মৌজায় একযোগে কার্যকর হবে।

এই পরিবর্তনের ফলে বঞ্চনা কমবে, প্রতারণা বন্ধ হবে, দীর্ঘসূত্রতা ও মামলা ব্যাপকভাবে কমে আসবে এবং প্রত্যেকে দ্রুত তাদের প্রাপ্য অংশ পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যে কোনো অভিযোগ বা তথ্য জানতে সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস বা আদালতে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে কোন আদেশ জারি হয়েছে?

এই চারটি নিয়ম মূলত একটি একক “আদেশ” বা “আইন” দ্বারা তৈরি হয়নি, বরং ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক কিছু সার্কুলার (পরিপত্র) এবং ভূমি সংক্রান্ত নতুন আইন, বিশেষ করে ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩-এর কঠোর বাস্তবায়ন ও সমন্বিত রূপ।

যে বিষয়গুলো আপনার উল্লিখিত নিয়মের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে, তার মধ্যে প্রধান দুটি হলো:

১. ভূমি মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র (যৌথ নামজারি/খতিয়ান):

আপনার নিয়ম–২ (সব ওয়ারিশকে উপস্থিত রেখে ‘যৌথ খতিয়ান’ তৈরি বাধ্যতামূলক) এর মূল ভিত্তি হলো ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিপত্র

  • বিষয়বস্তু: ভূমি মন্ত্রণালয় সম্প্রতি একটি পরিপত্র জারি করে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ওয়ারিশদের যৌথভাবে নামজারি (মিউটেশন) করার আবেদন বন্টননামা দলিলের (partition deed) অজুহাতে নামঞ্জুর করা যাবে না

  • কার্যকারিতা: এই পরিপত্রের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে, ওয়ারিশ সনদ (Inheritance Certificate) ব্যবহার করে একজন মৃত ব্যক্তির খতিয়ানে তার সকল ওয়ারিশের অংশ উল্লেখ করে যৌথ খতিয়ান (Joint Khotian) তৈরি করা আইনসিদ্ধ। এটি এককভাবে নামজারি করে সম্পত্তি গোপন করার সুযোগকে কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে।

২. ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩:

আপনার উল্লিখিত নিয়ম–১ (ওয়ারিশকে বঞ্চনা করা) এবং নিয়ম–৩ (দখল সত্ত্বেও অধিকার অটুট) এর কঠোরতা এই আইনের মাধ্যমে এসেছে।

  • ওয়ারিশ বঞ্চনা (নিয়ম-১): নতুন আইন অনুযায়ী, অন্য ওয়ারিশকে তার প্রাপ্য অংশ থেকে বঞ্চিত করা, জাল দলিল বা খতিয়ান তৈরি করাকে গুরুতর ভূমি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আপনার উল্লিখিত ৭ বছর কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা এই আইনের আওতায় অপরাধ ও শাস্তির বিধানকে সমর্থন করে।

  • দখল সত্ত্বেও অধিকার অটুট (নিয়ম-৩): এই আইনটি জমির প্রকৃত মালিকানা প্রমাণে দলিল ও রেকর্ডকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় এবং জাল রেকর্ড তৈরি, বা দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে দখলে থাকাকে নিরুৎসাহিত করে। ফলস্বরূপ, আইনসম্মত রেকর্ড সংশোধনের মাধ্যমে প্রতারিত ওয়ারিশদের জন্য জমি ফেরত পাওয়া এখন সহজতর হয়েছে।

৩. প্রি-এমশন (নিয়ম-৪):

ওয়ারিশদের না জানিয়ে সম্পত্তি বিক্রি নিষিদ্ধ করা এবং প্রি-এমশন (অগ্রক্রয়) মামলার বিষয়টি ভূমি ব্যবস্থাপনায় নতুন নয়। এটি রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০-এর অধীনে দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত। তবে ভূমি বিরোধ সংক্রান্ত নতুন আইনের মাধ্যমে এই অধিকারকে আরও সুসংহত ও কার্যকর করা হয়েছে।

সংক্ষেপে, এই “চারটি নিয়ম” কোনো একটিমাত্র আদেশ নয়, বরং বিভিন্ন সময়ে প্রণীত আইন ও সম্প্রতি জারি করা সরকারি নির্দেশনাগুলোর একটি সম্মিলিত উদ্যোগ, যার মূল লক্ষ্য হলো উত্তরাধিকার সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *