সূচীপত্র
ব্যাংকে থাকা টাকা মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী নাকি নমিনি পাবেন এমন প্রশ্নে আদালত ও ব্যাংক আইনের নির্দেশনা সাংঘর্ষিক- তবে সর্বশেষ আইন প্রাধান্য পায় সব সময়ই- বাংলাদেশ ব্যাংক মানি ওয়ারিশ
ব্যাংকের টাকা নিয়ে হাইকোর্ট কি বলে? – মৃত ব্যক্তির ব্যাংকে জমাকৃত টাকা নমিনি পাবেন না, এ অর্থ উত্তরাধিকারী পাবেন বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। রোববার এ রায় ঘোষণা করা হয়। বিচারপতি নাঈমা হায়দারের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এসময় আদালতে এ বিষয়ে দায়ের করা রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী এমআই ফারুকী। মামলার বিবরণীতে দেখা যায়, ২০১৪ সালের মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি ডিরেক্টর শহিদুল হক চৌধুরী তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নমিনি করে ৩০ লক্ষ টাকার সঞ্চয়পত্র রাখে। পরে শহিদুল হক মারা গেলে তার দ্বিতীয় স্ত্রী পুরো টাকা একাই ভোগ করতে চাইলে মৃত শহীদুলের প্রথম পক্ষের সন্তানরা টাকা দাবি করে মামলা করে। তবে নিম্ন আদালত রায় দেন, নমিনি যে সেই টাকা পাবে।
এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করলে, রোববার মৃত ব্যক্তির ব্যাংকে থাকা টাকা নমিনি নয়, উত্তরাধিকারীরা পাবেন বলেন রায় দিলেন আদালত।আদালতে রিভিশন আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী, সঙ্গে ছিলেন সাদেকুর রহমান ও নাজনীন নাহার। অন্যপক্ষে (মৃত ব্যক্তির দ্বিতীয় স্ত্রী) ছিলেন আইনজীবী বি এম ইলিয়াস কচি ও মাকসুদুল ইসলাম। রায়ের পর আইনজীবী নাজনীন জানান, “সঞ্চয়পত্রের মালিকের নমিনি ট্রাস্টি হিসেবে থাকবে, মালিক মারা গেলে নমিনি ওই অর্থ উত্তোলনের অধিকারী হবেন ও উত্তরাধিকার আইন অনুসারে মৃত ব্যক্তির সাকসেসরদের (উত্তরাধিকারী) মধ্যে তা বণ্টন করবেন। নমিনি যদি উত্তরাধিকারী হন, তবে তিনি ওই অর্থের মালিকানা পাবেন বলে রায় দিয়েছে আদালত; অন্যথায় নয়।
ব্যাংক, ইন্সুরেন্সে তাহলে নমিনির দরকার কি? প্রচলিত আইনে নমিনি ও উত্তরাধিকারী বিষয়ে স্পষ্ট বলা রয়েছে জানিয়ে অ্যাডভোকেট নাজনীন বলেন, “প্রচলিত ধারণা, নমিনিই সঞ্চয়পত্রের অর্থের মালিকানা পাবে। হাই কোর্টের রায়ের ফলে এখন বিষয়টি আরও স্পষ্ট হল।” নমিনির ভূমিকা কি ছিল আগে : ব্যাংক, ইন্সুরেন্স ইত্যাদির ক্ষেত্রে নমিনির ভুমিকা হল ট্রাস্টির মত। অর্থাৎ নমিনির কাজ হল যখন একাউন্ট হোল্ডার মারা যাবেন তখন নমিনি ওই একাউন্ট সম্পর্কিত যাবতীয় কাজ করবেন (যেমনঃ একাউন্ট এ রক্ষিত টাকা তুলবেন।) এবং সম্পত্তিটি একাউন্ট হোল্ডারের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টন করে দিবেন ।
ব্যাংক গ্রাহকের মৃত্যুতে নমিনির টাকা উত্তোলনের নিয়ম। মৃত ব্যক্তির ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করার জন্য কি আবেদন করতে হয়? । হাইকোর্টের রায় মূলত কি ছিল? সর্বশেষ ব্যাংক আইনই প্রাধান্য পাইবে
রায়টা ছিল এমন- “The provisions (relating to insurance and housing societies) are made merely to give a valid discharge to the insurance company or the cooperative society without vesting the ownership rights in the insurance policy or the membership rights in the Society upon such nominee,” said the judge, while pointing out that the provisions of the Companies Act and Depositories Act, that govern equity shares are different. Both these laws say that the shares would be vested with the nominee on the death of the share holder.”
Caption: Info Source
মৃত ব্যক্তির ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত ।সঞ্চয়পত্রের নমিনি কি টাকা পাবে?
- বাংলাদেশে কোন ব্যক্তি মারা গেলে তার ব্যাংকের অ্যকাউন্টে গচ্ছিত টাকা বা সঞ্চয়পত্রের মতো বিষয়গুলো কে পাবে তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই বিভ্রান্তি রয়েছে। বিশেষ করে ওই ব্যক্তি যদি উত্তরাধিকারীদের বাইরে কাউকে নমিনি হিসেবে মনোনীত করে যান তাহলে তা নিয়ে তৈরি হয় নানা জটিলতা।
- কারণ দেশটিতে অনেকেই তাদের ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ হিসেব করার সময় নমিনির বিষয়টিতে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। বরং শুধু মাত্র একটি নাম দেয়া দরকার মনে করে অনেকে নমিনি হিসেবে ইচ্ছেমতো তার পরিচিত কারও নাম দিয়ে দেন।
- আবার অনেক সময় সন্তানরা খুব ছোট থাকার কারণেও কেউ কেউ বন্ধু, আত্মীয় বা পরিচিত কারও নাম নমিনি হিসেবে দেন।
- ফলে অনেক সময় ওই ব্যক্তি মারা গেলে নমিনি সব অর্থ নিয়ে নিচ্ছেন এবং মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, সন্তান অর্থাৎ ওয়ারিশদের বঞ্চিত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
- এখন প্রশ্ন উঠেছে যে ওই ব্যক্তি মারা গেলে ব্যাংক তার অ্যাকাউন্টে থাকা টাকা কাকে দেবে? নমিনি হিসেবে যার নাম তিনি দিয়েছিলেন তাকে নাকি ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী যারা তাদের?
- নমিনি যদি উত্তরাধিকারীদের কেউ হন তাহলে তিনিই কি সব টাকা পাবেন নাকি মৃত ব্যক্তির আরও উত্তরাধিকারী যদি থাকে তারাও সেই টাকার অংশ পাবেন- এগুলো নিয়েও আছে বিতর্ক।
- ব্যাংক আইন বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ বলছেন আইন অনুযায়ী নমিনিই মৃত ব্যক্তির ব্যাংক হিসেবে থাকা টাকা পাবেন, তবে সে কারণে উত্তরাধিকারীরা সেই অর্থ থেকে যে বঞ্চিত হবেন সেটা না।
- তার মতে কেউ মারা গেলে তার সঞ্চিত অর্থ বা তার অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ নমিনিকে দিয়ে এ সম্পর্কিত প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত হবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
- “এরপর বিষয়টি হলো নমিনি ও উত্তরাধিকারীদের। আইনে বলা আছে নমিনিকে দেয়া মানে উত্তরাধিকারীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়া নয়। অর্থাৎ নমিনি যদি উত্তরাধিকারীদের সেই টাকা না দেন, তাহলে তারা আদালতে যেতে পারবেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
- অর্থাৎ প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যাংক তার দায়িত্ব পালন শেষ করবে নমিনির হাতে অর্থ তুলে দিয়ে। কিন্তু তিনি যদি সেই অর্থ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিতরণ না করেন তাহলে তারা আদালতে যেতে পারবে।
- এর মানে হলো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা পাওয়ার পর নমিনির কাজ হবে ওই ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারীদের সেটি বুঝিয়ে দেয়া।
- সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী নাজনীন নাহার বলছেন যে নমিনি ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ট্রাস্টির ভূমিকা পালন করেন বা ওই হিসেবের ম্যানেজার মাত্র।
- আইন অনুযায়ী ম্যানেজার হিসেবে তিনি ওই অর্থ মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের হাতে তুলে দেবেন। যদিও তা না করে অনেক ক্ষেত্রে নমিনি টাকা নিজে রেখে দিচ্ছেন বলে দেখা যাচ্ছে- যা আইনের লঙ্ঘন বলে তিনি বলছেন।
- “নমিনি ওই অর্থ উত্তোলনের অধিকারী হবেন ও উত্তরাধিকার আইন অনুসারে মৃত ব্যক্তির সাকসেসরদের (উত্তরাধিকারী) মধ্যে তা বণ্টন করবেন। তা না হলে উত্তরাধিকারীরা আদালতে গেলে প্রতিকার পাবেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন নাজনীন নাহার।
- আইনজীবী নাজনীন নাহার এ ধরনের একটি মামলায় এক পক্ষে আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নমিনি করে সঞ্চয়পত্র রেখেছিলেন।
- পরে তিনি মারা গেলে তার দ্বিতীয় স্ত্রী ওই সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে পুরো টাকা একাই ভোগ করতে চাইলে আইনের আশ্রয় নেন তার প্রথম পক্ষের সন্তানরা।
- এ নিয়ে প্রথমে নিম্ন আদালত বলেছিল যে নমিনিই সেই টাকা পাবেন। কিন্তু পরে হাইকোর্টে যায় বিষয়টি। হাইকোর্ট তার রায়ে বলে যে ওই টাকা পাবেন মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীরাই। এরপর হাইকোর্টের এ রায় চেম্বার আদালতে স্থগিত হয়ে এখন আপিল বিভাগে পূর্ণাঙ্গ শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
- বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি বলে আগের রায়ই কার্যকর আছে বলে জানিয়েছেন নাজনীন নাহার। আর সে রায় অনুযায়ী নমিনির কাছেই হিসেবের টাকা হস্তান্তর করবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
ওয়ারিশগণ মামলা না করলে কি নমিনি পায়?
এই ক্ষেত্রে অনেকেই একটি ভূল করে থাকেন । সেটা হল অনেকেই ভাবেন যে, নমিনি হল ওই একাউন্ট এর মালিক। এই ধারনা সম্পূর্ন ভূল। নমিনি হল ওই একাউন্ট এর হেফাজতকারী মাত্র। তিনি মৃত ব্যক্তির পক্ষে একাউন্ট পরিচালনাকারী মাত্র। মৃত ব্যক্তির টাকা বন্টিত হবে সাকসেসন আইন অনুযায়ী। নমিনি যদি মৃত ব্যক্তির উত্ত্রাধিকারী না হন তবে কোন অবস্থায় তিনি সম্পত্তির দাবিদার নন। সাকসেসন আইন অনুযায়ী নমিনি যদি কোন টাকা পাওয়ার অধিকারী হন তবে তিনি তা এমনিতেই পাবেন। নমিনি হওয়ার কারনে তিনি অন্য কোন বিশেষ অধিকার ভোগ করবেন না। এই ব্যাপারে সাকসেসন আইন দ্রষ্টব্য। এই বিষয়ে ভারতীয় একটি মামলার রেফারেন্স দেয়া যেতে পারে। যেখানে বিচারপতি আর.এস জোধি বলেন, “Any amount paid to the nominee after valid deductions becomes the estate of the deceased.” তিনি আরও বলেন নমিনি হল ডিপোজিটর মাত্র।