সূচীপত্র
চূড়ান্তভাবে মুদ্রিত ও প্রকাশিত খতিয়ান বা স্বত্বলিপিতে (Record of Rights) করণিক ভুল (Clerical Mistake), প্রতারণামূলক লিখন (Fraudulent Entry) এবং প্রকৃত বা যথার্থ ভুল (Bona fide Mistake) সংশোধনের বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় একটি নতুন পরিপত্র জারি করেছে । এই পরিপত্রে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা রাজস্ব অফিসারের এখতিয়ার সুস্পষ্ট করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যা ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি এবং জনগণের ভোগান্তি লাঘবে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে ।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের জারি করা এই পরিপত্রের মাধ্যমে সর্বশেষ জরিপে প্রস্তুত ও চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত খতিয়ানের উল্লিখিত তিন ধরনের ভুল সংশোধনে জনগণকে আদালতে না গিয়ে সরাসরি উপজেলা বা সার্কেল ভূমি অফিসে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে ।
📝 যে সকল ভুল সংশোধন করা যাবে ভূমি অফিসে:
পরিপত্র অনুযায়ী, নিম্নোক্ত ভুলগুলো সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্তৃক সংশোধনের সুযোগ রয়েছে:
১. করণিক ভুল (Clerical Mistake):
যে ভুল সরল বিশ্বাসে, ভুলক্রমে বা অসাবধানতাবশত হয়েছে এবং যার পিছনে অসাধু উদ্দেশ্য ছিল না, তাকে করণিক ভুল বলে গণ্য করা হয় । এই ভুল সংশোধন করলে কারও স্বত্ব স্বার্থের ক্ষতি হবে না ।
উদাহরণস্বরূপ, বহুল প্রচলিত কিছু করণিক ভুল:
নাম বা ঠিকানায় ভুল: মালিক, পিতা, মাতা বা স্বামীর নাম, পদবি বা বংশ পরিচয়ে ভুল । যেমন: ‘আব্দুর রহমানের’ স্থলে ‘আব্দুল রাহমান’ লেখা ।
ঠিকানায় ভুল: গ্রামের নাম, মৌজার জেএল নম্বর, বিভাগ, জেলা বা উপজেলার নামে ভুল ।
গাণিতিক ভুল: খতিয়ানে অংশের গাণিতিক ভুল (যেমন: ৫০:৫০ এর স্থলে ৬০:৫০ লেখা), দাগ নম্বরে ভুল (যেমন: ৫১০ এর স্থলে ৫০১ বা ৪১০ লেখা) বা দাগ ভুলক্রমে বাদ পড়ে যাওয়া, জমির পরিমাণে ভুল (যেমন: ১.২৭ একরের স্থলে ১.০২৭ একর লেখা) ।
জমির শ্রেণির ভুল: আবাদি, ভিটি, হাট, আবাসিক—এসব শ্রেণির একটির স্থলে অন্যটি লেখা ।
তবে, করণিক ভুল সংশোধনে যদি স্বত্বকে প্রভাবিত করে, যেমন অন্যের স্বত্বের পরিবর্তন ঘটে বা কেউ লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে রাজস্ব অফিসারের এখতিয়ার থাকবে না এবং তা দেওয়ানি বিরোধ বলে গণ্য হবে ।
২. প্রতারণামূলক অন্তর্ভুক্তি (Fraudulent Entry):
প্রতারণামূলকভাবে জমির মালিকানা, অংশের হিস্যা বা পুরানো ডকুমেন্ট সংক্রান্ত তথ্য খতিয়ানে লিপিবদ্ধ করে ভূমি মালিকের স্বত্বের ক্ষতি করা বুঝায় । রাজস্ব অফিসার (এসি ল্যান্ড) এই প্রতারণামূলক ভুক্তি সংশোধনের এখতিয়ার রাখেন ।
উদাহরণস্বরূপ:
জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্ট খতিয়ান ।
খতিয়ানের ২ নং কলামে অংশের তঞ্চকতাপূর্ণ অন্তর্ভুক্তি বা ওয়ারিশান অনুযায়ী হিস্যা রেকর্ড না হওয়া ।
সরকারি (১ নং) খতিয়ানের জমি, অর্পিত সম্পত্তি, ওয়াকফ বা দেবোত্তর সম্পত্তি প্রতারণামূলকভাবে ভিন্ন নামে রেকর্ড হওয়া ।
সতর্কতা: এই ক্ষেত্রে যদি স্বত্ব স্বার্থের সংশ্লিষ্ট বিরোধ (Civil Litigation) বিদ্যমান বলে প্রতীয়মান হয়, তবে সহকারী কমিশনার (ভূমি) কোনো কার্যক্রম গ্রহণ না করে আবেদনকারীকে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল বা দেওয়ানি আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার নিতে পরামর্শ দেবেন ।
৩. প্রকৃত ভুল বা যথার্থ ভুল (Bona fide Mistake):
জরিপের সময় কোনো প্রতারণার উদ্দেশ্য ছাড়া সরল বিশ্বাসে করা ভুলকে প্রকৃত বা যথার্থ ভুল বলা হয় । এই ভুল এতই দৃশ্যমান যে সংশোধন ছাড়াই মালিকানা সুস্পষ্ট হয় ।
উদাহরণস্বরূপ:
পিতার নামে সম্পত্তি রেকর্ড হওয়ার কথা থাকলেও পিতার মৃত্যুর কারণে তা সন্তানদের নামে রেকর্ড না হওয়া ।
বৈধভাবে অর্জিত মালিকের নামে চূড়ান্ত রেকর্ড না করে পূর্ববর্তী রেকর্ডীয় মালিকের নামে প্রকাশ করা ।
আদালতের চূড়ান্ত রায় বা আদেশে স্বত্ব ঘোষিত ব্যক্তির নামে রেকর্ড না হয়ে পূর্বরেকর্ডীয় ব্যক্তির নামে বা সরকারের নামে রেকর্ড হওয়া ।
অধিগ্রহণ বা অন্য বৈধ কারণে অর্জিত ভূমি সরকার বা সংস্থার নামে না হয়ে পূর্বরেকর্ডীয় ব্যক্তির নামে থেকে যাওয়া ।
সংশোধন পদ্ধতি: এই ধরনের সরল প্রকৃতির ভুল সংশোধনের জন্য সহকারী কমিশনার (ভূমি) আলাদা মিস কেস গ্রহণ না করে সরাসরি নামজারি কেস গ্রহণ করেই রেকর্ড সংশোধন করতে পারবেন । তবে জটিলতার ক্ষেত্রে নথি সরাসরি ভূমি আপিল বোর্ডে প্রেরণ করতে হবে এবং বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে ।
✅ দ্রুত নিষ্পত্তির সুস্পষ্ট নির্দেশনা
পরিপত্রে ভুল সংশোধনের পদ্ধতিও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আবেদন প্রাপ্তির পর সহকারী কমিশনার (ভূমি) অনধিক ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে সিদ্ধান্ত বা আদেশ প্রদান করবেন । আবেদন দাখিলের দিনেই আবেদনকারীকে বা তার প্রতিনিধিকে কেস নম্বরসহ প্রাপ্তিস্বীকার পত্র প্রদান করা আবশ্যিক, অন্যথায় তা কর্তব্যে অবহেলা বলে গণ্য হবে । এই উদ্যোগটির লক্ষ্য হচ্ছে ভূমি সংক্রান্ত সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া এবং যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে ভুল সংশোধনের সেবা নিশ্চিত করা ।
ভূমি মন্ত্রণালয় আশা করছে যে এই যুগান্তকারী পদক্ষেপের ফলে লক্ষ লক্ষ মামলার জট কমবে এবং রেকর্ড ভুলের কারণে সৃষ্ট জনগণের সীমাহীন ভোগান্তি দ্রুত নিরসন হবে ।

লাখো মামলার জট কমাবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগান্তকারী পরিপত্র
ভূমি অফিসের করণিক ভুল সংশোধনের জন্য কোথায় আবেদন করতে হবে?
ভূমি অফিসের করণিক ভুল সংশোধনের জন্য আপনাকে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা রাজস্ব অফিসারের নিকট আবেদন করতে হবে ।
📌 আবেদনের স্থান ও প্রক্রিয়া:
- আবেদন কোথায় জমা দেবেন: প্রত্যেক উপজেলা বা সার্কেল ভূমি অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর কার্যালয়ে আবেদন দাখিল করতে হবে ।
- কারা আবেদন করতে পারবেন: সংশ্লিষ্ট খতিয়ানধারী ভূমি মালিক, তার বৈধ উত্তরাধিকারী, বা স্বার্থাধিকারী আবেদন করতে পারবেন ।আবেদন গ্রহণের নিয়ম: আবেদনকারীকে আবেদনের কারণ বর্ণনা করে এবং জাতীয় পরিচয়পত্রসহ কাগজপত্র (যদি থাকে) সত্যায়িত অনুলিপি সহকারে সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে সম্বোধন করে নিজ স্বাক্ষরে বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধির স্বাক্ষরে আবেদন দাখিল করতে হবে ।
- প্রাপ্তি স্বীকার: সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর দপ্তরে আবেদন দাখিলের দিনেই আবেদনকারীকে বা তার প্রতিনিধিকে রেকর্ড সংশোধন মিস কেস নম্বরসহ আবেদনের প্রাপ্তিস্বীকার পত্র প্রদান করতে হবে ।
