সূচীপত্র
বছর ঘুরে আবারও ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ, আর এর সাথে সাথে ব্যাংক গ্রাহকদের মধ্যে শুরু হয়েছে প্রচলিত ‘আহাজারি’। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায়, “অমুক ব্যাংক আমার সব টাকা কেটে নিছে! ব্যাংক ডাকাত! গলাকাটা চার্জ!” কিন্তু ব্যাংক কি আসলেই ইচ্ছেমতো অতিরিক্ত চার্জ কাটে? তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, গ্রাহকের এই ক্ষোভের মূলে রয়েছে মূলত চারটি প্রধান চার্জ – যার বেশিরভাগই বাংলাদেশ ব্যাংকের শিডিউল এবং সরকারি নিয়ম দ্বারা নির্ধারিত।
১. অ্যাকাউন্ট মেইনটেন্যান্স চার্জ: বছরে দু’বার
সেভিংস অ্যাকাউন্টে গ্রাহকের প্রধান অভিযোগের একটি হলো ‘অ্যাকাউন্ট মেইনটেন্যান্স চার্জ’। ব্যাংক এই চার্জ বছরে দুইবার (জুন ও ডিসেম্বর) কেটে থাকে।
নির্দেশনা ও চার্জের ভিত্তি: বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী এই চার্জ নির্ভর করে অ্যাকাউন্টের গড় ব্যালান্সের উপর।
গড় ব্যালান্স ৫,০০০ টাকার কম হলে কোনো চার্জ নেই।
গড় ব্যালান্স ২৫,০০০ টাকার কম হলে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা চার্জ (ভ্যাট বাদে)।
গড় ব্যালান্স ২৫,০০০ টাকার বেশি হলে ব্যাংক তার নিজস্ব শিডিউল অনুযায়ী চার্জ আদায় করে, যা ব্যালান্স বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে।
প্রযোজ্যতা: এই চার্জের উপর ১৫% ভ্যাট প্রযোজ্য।
২. আবগারি শুল্ক (Excise Duty): ডিসেম্বরের ‘পাপ কর’
গ্রাহকদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হলো আবগারি শুল্ক (Excise Duty) বা ‘পাপ কর’। এই চার্জ ডিসেম্বর মাসে বছরে একবার কাটা হয়। এটি সম্পূর্ণভাবে সরকারের কোষাগারে জমা যায়।
নির্ধারণের ভিত্তি: এটি নির্ধারিত হয় বছরের যেকোনো সময় অ্যাকাউন্টের সর্বোচ্চ ব্যালান্সের ওপর।
স্ল্যাব (সর্বশেষ বাজেট অনুযায়ী):
সর্বোচ্চ ব্যালান্স ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত: শূন্য। (আগে যা ছিল ১ লাখ টাকা)
৩ লাখ ১ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত: ১৫০ টাকা।
৫ লাখ ১ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত: ৫০০ টাকা।
১০ লাখ ১ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত: ৩,০০০ টাকা।
৫০ লাখ ১ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত: ৫,০০০ টাকা।
১ কোটি ১ টাকা থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত: ১০,০০০ টাকা।
৫ কোটির উপরে: ৫০,০০০ টাকা।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
এক সেকেন্ডের জন্যেও যদি অ্যাকাউন্টে উচ্চ স্ল্যাবের অর্থ জমা হয়, পুরো বছরের জন্য সেই স্ল্যাবের শুল্ক প্রযোজ্য হবে।
বর্তমানে ডিপোজিট অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি লোন অ্যাকাউন্টেও (২০১৮ সাল থেকে) আবগারি শুল্ক আরোপ করা হয়। অর্থাৎ, ১০ লাখ টাকার লোন নিলে দুটি অ্যাকাউন্টে মোট ৬,০০০ টাকা আবগারি শুল্ক লাগতে পারে।
৩. এসএমএস অ্যালার্ট ও ডেবিট কার্ড ফি
এসএমএস অ্যালার্ট ফি: বেশিরভাগ ব্যাংক বছরে দুইবার এই ফি আদায় করে। সাধারণত ১০০ টাকা বা ২০০ টাকা হয়ে থাকে, যার সাথে ১৫% ভ্যাট যোগ হয় (যেমন ১০০ টাকার ক্ষেত্রে ১১৫ টাকা)।
ডেবিট কার্ড মেইনটেন্যান্স ফি: ডেবিট কার্ড ব্যবহার করলে বছরে দুইবার এই চার্জ দিতে হয়। অর্ধবার্ষিক চার্জ সাধারণত ২০০ টাকা থেকে শুরু হয় এবং এর সাথে ১৫% ভ্যাট প্রযোজ্য।
৪. সেভিংস অ্যাকাউন্টের সুদ ও জটিল শর্ত
ব্যাংক চার্জ কাটার পাশাপাশি সেভিংস অ্যাকাউন্টে ২.৫% থেকে ৪% হারে যৎসামান্য সুদও প্রদান করে। তবে বেশিরভাগ গ্রাহকই এই সুদ পান না বা কম পান। এর প্রধান কারণ হলো সুদের হিসাবের জটিল শর্তাবলী।
শর্ত:
এক সপ্তাহে দুইটির বেশি লেনদেন (উইথড্রয়াল/ট্রান্সফার) করা যাবে না।
একবারে মোট ব্যালান্সের ২৫% এর বেশি টাকা তোলা যাবে না।
সুদ হিসাবের পদ্ধতি: বেশিরভাগ ব্যাংক মিনিমাম মান্থলি ব্যালান্সের ওপর ভিত্তি করে সুদ হিসাব করে। অর্থাৎ, মাসের শুরুতে যদি অ্যাকাউন্টে সর্বনিম্ন ব্যালান্স থাকে, তবে পুরো মাসের লেনদেন যাই হোক, ওই সর্বনিম্ন ব্যালান্সের উপরই সুদ পাওয়া যাবে।
সোর্স ট্যাক্স: সুদের ওপর ১০% (টিআইএন ও রিটার্ন জমা দিলে) বা ১৫% (টিআইএন না থাকলে/রিটার্ন জমা না দিলে) হারে সোর্স ট্যাক্স কেটে রাখা হয়।
🔥 চার্জ থেকে বাঁচার উপায় ও ভবিষ্যৎ উদ্বেগ
গরীব গ্রাহকদের চার্জ থেকে সাময়িকভাবে বাঁচার একটি উপায় হলো জুন বা ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের আগে অ্যাকাউন্ট থেকে বেশিরভাগ টাকা তুলে ফেলা। তবে কিছু ব্যাংক এখন ডিসেম্বরের শুরু থেকেই চার্জ কাটছে এবং অনেক ব্যাংকে ন্যূনতম ব্যালান্স (৫০০/১,০০০ টাকা) রাখার বাধ্যবাধকতা থাকে।
উদ্বেগের বিষয় হলো, অনেক ব্যাংকই চার্জের সমপরিমাণ অর্থ না থাকলে অ্যাকাউন্টের ওয়ার্কিং ব্যালান্স নেগেটিভ করে রাখে। ভবিষ্যতে টাকা জমা পড়লে সেই নেগেটিভ ব্যালান্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে নেওয়া হয়। অদূর ভবিষ্যতে আরও ব্যাংক এই পদ্ধতি অবলম্বন করার পরিকল্পনা করছে বলে জানা যায়।
তবে কিছু ব্যাংক গ্রাহক আকর্ষণে নতুন পণ্য চালু করেছে, যেমন আইএফআইসি ব্যাংকের ‘আমার অ্যাকাউন্ট’ বা এসবিএসি ব্যাংকের ‘সুরক্ষা সঞ্চয়ী হিসাব’, যেখানে ডেইলি ব্যালান্সের ওপর মুনাফা এবং বিনামূল্যে লাইফ ইন্স্যুরেন্সের (সাধারণ মৃত্যুতে ৫০,০০০ টাকা, দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে ৫,০০,০০০ টাকা) মতো সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যাংকের চার্জগুলি শিডিউল মেনে এবং সরকারের নির্দেশনা মোতাবেকই কাটা হয়। গ্রাহকের আহাজারি মূলত সঠিক তথ্যের অভাব, ডিসেম্বরে একাধিক চার্জের একযোগে কর্তন এবং আবগারি শুল্কের উচ্চ স্ল্যাবের কারণে তৈরি হয়। গ্রাহকদের উচিত নিজ নিজ ব্যাংকের ‘শিডিউল অব চার্জ’ ও ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা’ সম্পর্কে অবহিত থাকা।
আপনার জিজ্ঞাসার জন্য ধন্যবাদ। সঞ্চয়ী হিসাবে অর্থের উপর সুদের হার বিভিন্ন ব্যাংকের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হয় এবং এটি মূলত অ্যাকাউন্টের ধরন, জমাকৃত টাকার পরিমাণ (স্ল্যাব) এবং সুদ হিসাব করার পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে।
সাধারণত, সেভিংস অ্যাকাউন্টে সুদের হার ২.৫% থেকে ৫.৫% এর মধ্যে হয়ে থাকে। তবে বিশেষ কিছু অ্যাকাউন্টে (যেমন কর্পোরেট পে-রোল, নির্দিষ্ট স্কিম বা উচ্চ ব্যালেন্সের অ্যাকাউন্ট) এই হার কিছুটা বেশি হতে পারে।
এখানে কিছু ব্যাংকের সেভিংস অ্যাকাউন্টের সুদের হারের একটি তুলনামূলক চিত্র (প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে):
🏦 সঞ্চয়ী হিসাবে সুদের হারের তুলনা (উদাহরণ)
| ব্যাংকের নাম | অ্যাকাউন্টের ধরন / পণ্যের নাম | ব্যালেন্স স্ল্যাব | সুদের হার (বার্ষিক) |
| আইএফআইসি ব্যাংক | IFIC Amar Account | ৫০,০০,০০১ টাকার উপরে | ৫.৫% |
| ২০,০০,০০১ থেকে ৫০,০০,০০০ টাকা | ৫.০% | ||
| ২৫,০০০ থেকে ৫,০০,০০০ টাকা | ৪.০% | ||
| ট্রাস্ট ব্যাংক | Trust Unfixed Deposit (TUD) | ২,৫০০,০০১ টাকার উপরে | ৫.৫% |
| ৫,০০,০০১ থেকে ২৫,০০,০০০ টাকা | ৫.০% | ||
| ওয়ান ব্যাংক (ONE Bank) | Elegant Savings | ১০ লাখ টাকার উপরে | ৫.০% |
| School/Youth Banking | যেকোনো পরিমাণ | ৫.০% | |
| সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (SBAC) | SBAC Probashi Savings | ন্যূনতম ১,০০০ টাকা | ৫.০% |
| ব্যাংক এশিয়া | STAR Savings Account | ১০ কোটি টাকার উপরে | ৬.০% |
| ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা | ৫.০% | ||
| আগ্রানী ব্যাংক | Agrani Super Savings Scheme | ১০,০০,০০১ টাকার উপরে | ৩.৭৫% |
| ইস্টার্ন ব্যাংক (EBL) | EBL 50+ Savings | ৫ লক্ষ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টাকা | ৪.০% |
| মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (MTB) | সাধারণ সেভিংস অ্যাকাউন্ট | সর্বোচ্চ | ২.৫% |
| ঢাকা ব্যাংক | DBL SAVINGS ACCOUNT | সর্বোচ্চ | ২.৭৫% |
বি. দ্র.: এই হারগুলি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ওয়েবসাইট বা সর্বশেষ প্রকাশিত হার অনুযায়ী দেওয়া হয়েছে। সুদের হার যেকোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে এবং ব্যাংকভেদে সুদ হিসাবের পদ্ধতি (দৈনিক/মাসিক ন্যূনতম/গড় ব্যালেন্স) ভিন্ন হওয়ায় আপনার প্রাপ্ত প্রকৃত সুদের পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে।
🏆 কোন ব্যাংক বেশি সুদ দেয়?
উপরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, সাধারণ সেভিংস অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ব্যাংকের সুদের হার ৩.০০% থেকে ৪.০০% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
তবে, উচ্চ ব্যালেন্সের জন্য এবং বিশেষ স্কিমের ক্ষেত্রে কিছু ব্যাংক উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি সুদ দেয়:
ব্যাংক এশিয়া (Bank Asia): তাদের STAR Savings Account এ ১০ কোটি টাকা বা তার বেশি ব্যালেন্সের জন্য ৬.০% পর্যন্ত সুদ প্রদান করে, যা সাধারণ সেভিংস অ্যাকাউন্টের মধ্যে সর্বোচ্চ।
আইএফআইসি ব্যাংক (IFIC Bank): তাদের IFIC Amar Account এ ৫০ লাখ টাকার বেশি ব্যালেন্সের জন্য ৫.৫% সুদ দিচ্ছে। এই অ্যাকাউন্টটি দৈনিক ব্যালেন্সের ভিত্তিতে সুদ দেয়, যা গ্রাহকের জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি সুবিধাজনক।
ওয়ান ব্যাংক (ONE Bank): স্কুল ও ইয়ুথ ব্যাংকিংয়ের মতো বিশেষ অ্যাকাউন্টে ৫.০% সুদ প্রদান করছে।
💡 আপনার জন্য পরামর্শ
শুধুমাত্র সুদের হারের দিকে না তাকিয়ে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বিবেচনা করা উচিত:
সুদ হিসাবের পদ্ধতি: দৈনিক ব্যালেন্সের ওপর সুদ হিসাব করলে আপনার লাভ বেশি হবে (যেমন: IFIC Amar Account)। বেশিরভাগ ব্যাংক ন্যূনতম মাসিক ব্যালেন্সের ওপর সুদ হিসাব করে, যা সাধারণত কম হয়ে থাকে।
শর্তাবলী: সুদের সম্পূর্ণ সুবিধা পেতে অ্যাকাউন্টের লেনদেনের শর্তাবলী (যেমন: সপ্তাহে দুইটির বেশি লেনদেন না করা, মোট ব্যালেন্সের ২৫% এর বেশি না তোলা) অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
অন্যান্য চার্জ: অ্যাকাউন্ট মেইনটেন্যান্স ফি, ডেবিট কার্ড ফি এবং এসএমএস চার্জের পরিমাণ যাচাই করে নিন। যে ব্যাংকে চার্জ কম, সেটিও আপনার জন্য ভালো হতে পারে।
আপনি যদি আপনার অর্থের ওপর আরও বেশি সুদ পেতে চান, তবে সেভিংস অ্যাকাউন্টের পরিবর্তে সঞ্চয়পত্র (National Savings Certificate) বা ফিক্সড ডিপোজিট (FDR) বিবেচনা করতে পারেন। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার সাধারণত সেভিংস অ্যাকাউন্টের চেয়ে অনেক বেশি (১১% এর উপরে)।
