সূচীপত্র
সরকার মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৪ (১৯৭৪ সনের LII নং আইন)-এর ১৪ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯’ এ গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী এনেছে। গত ১ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ থেকে এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এই সংশোধনের ফলে এখন থেকে মুসলিম বিবাহ ও তালাকের ক্ষেত্রে ‘আলিম’ অথবা ‘আল-হাইআতুল উলইয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ (কওমি মাদ্রাসা)-এর অধীনে নিবন্ধিত ‘কওমি মাদ্রাসাসমূহ’ হতে দেওয়া হাদীস (তাকমীল) ডিগ্রির সনদকে ‘আলিম’ শিক্ষাগত যোগ্যতার সমতুল্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো।
🌟 সংশোধনের মূল বিষয়
বিধিমালা, ২০০৯ এর বিধি ৮ এর দফা (ক) তে উল্লেখিত ‘আলিম’ শব্দের পর “অথবা ‘আল-হাইআতুল উলইয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর অধীনে নিবন্ধিত ‘কওমি মাদ্রাসাসমূহ’ হতে দেওয়া হাদীস (তাকমীল) শব্দগুলো সংযোজিত হইবে।”
এই সংযোজনের মাধ্যমে, নিকাহ নিবন্ধক (কাজী) নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার মানদণ্ডে কওমি মাদ্রাসার তাকমীল (দাওরায়ে হাদীস) সনদকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। এর ফলে, কওমি মাদ্রাসা থেকে তাকমীল ডিগ্রিধারীরাও এখন থেকে নিকাহ নিবন্ধক হিসেবে আবেদন করার সুযোগ পাবেন।
রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে এই প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জিয়াউল হক মোল্লা।

আলীম ও কওমীর মধ্যে পার্থক্য কি?
আলিম এবং কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা দুটি ভিন্ন ধারার মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার অংশ। এদের মধ্যে মূল পার্থক্যগুলো নিচে দেওয়া হলো, বিশেষত আপনি যে গেজেটটি দিয়েছেন তার প্রেক্ষাপটে:
| মূল পার্থক্য | আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা | কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা |
| শিক্ষা বোর্ড/নিয়ন্ত্রণ | এটি বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সিলেবাস অনুযায়ী পরিচালিত হয়। | এটি সাধারণত আল-হাইআতুল উলইয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ (Ha’iatul Ulya) এর অধীনে নিবন্ধিত বোর্ডসমূহ দ্বারা পরিচালিত হয়। এটি মূলত জনগণের আর্থিক অনুদানে পরিচালিত, সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত। |
| “আলিম” কী? | এটি আলিয়া মাদ্রাসার একটি স্তর বা ডিগ্রি, যা সাধারণত সাধারণ শিক্ষার উচ্চ মাধ্যমিক (HSC) সমমানের। এটি দাখিল (এসএসসি সমমান) এর পরের স্তর। | এখানে “আলিম” কোনো স্বতন্ত্র স্তর নয়, বরং এই ধারার সর্বোচ্চ স্তর হলো দাওরায়ে হাদীস (তাকমীল)। এই ডিগ্রিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ‘আলিম’ (ধর্মীয় পণ্ডিত) বলা হয়। |
| শিক্ষাগত যোগ্যতা | এখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান সহ আধুনিক ও সাধারণ শিক্ষা দেওয়া হয়। | এটি মূলত দারুল উলুম দেওবন্দ-এর মূলনীতির অনুকরণে পরিচালিত। এর পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় বিষয়, যেমন: আরবি, ফারসি, উর্দু, হাদীস, ফিকহ-এর ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। আধুনিক বা সাধারণ বিষয়ের সংযুক্তি তুলনামূলকভাবে কম। |
| সর্বোচ্চ স্তর | সর্বোচ্চ স্তর হলো কামিল (মাস্টার্স সমমান)। | সর্বোচ্চ স্তর হলো দাওরায়ে হাদীস (তাকমীল), যা বর্তমানে (আইন, ২০১৮ অনুযায়ী) মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি)-এর সমমান হিসেবে স্বীকৃত। |
| গেজেটে সম্পর্ক | নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) পদে আবেদনের জন্য এতদিন শুধুমাত্র আলিম সনদ (আলিয়া মাদ্রাসার উচ্চ মাধ্যমিক সমমানের ডিগ্রি) থাকার শর্ত ছিল। | নতুন গেজেট অনুযায়ী, এখন আল-হাইআতুল উলইয়া থেকে প্রদত্ত দাওরায়ে হাদীস (তাকমীল) সনদকেও আলিম যোগ্যতার সমতুল্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যার ফলে এই সনদধারীরাও কাজী পদে আবেদন করতে পারবেন। |
সংক্ষেপে:
আলিম (Alim) মূলত আলিয়া শিক্ষাব্যবস্থার একটি স্তর যা এইচএসসি’র সমমান।
কওমি (Qaumi) হলো একটি স্বতন্ত্র শিক্ষাব্যবস্থা, যা মূলত সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত এবং এর সর্বোচ্চ স্তরকে দাওরায়ে হাদীস (তাকমীল) বলা হয়। নতুন বিধিমালার মাধ্যমে এই তাকমীল সনদটি এখন কাজী নিয়োগের ক্ষেত্রে আলিম সনদের সমতুল্য বলে বিবেচিত হবে।
কওমী ও আলীম কি সমমান?
কওমি ও আলিম ডিগ্রির শিক্ষাগত মান বা স্তর সরাসরি এক নয়, তবে কিছু সরকারি ও পেশাগত ক্ষেত্রে এখন তাদের সমতুল্য (Equivalent) মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এখানে মূল বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো:
✅ সমমান ও পার্থক্য
১. ডিগ্রির স্তরগত পার্থক্য
আলিম: এই শব্দটি মূলত আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার একটি স্তরকে বোঝায়। এটি সাধারণ শিক্ষার উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (HSC) পরীক্ষার সমতুল্য।
কওমি (দাওরায়ে হাদীস/তাকমীল): কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর হলো দাওরায়ে হাদীস (বা তাকমীল)। এটি ডিগ্রি নয়, বরং সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করার পর প্রদত্ত সনদ।
২. বর্তমানে সমতুল্যতা (Equivalence)
সরকারি স্বীকৃতি অনুযায়ী, কওমি ও আলিম ডিগ্রির সমতা বর্তমানে দুইটি ভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য:
| ক্ষেত্র | কওমি সনদ | আলিয়া সনদ | মান্যতা বা সমতুল্যতা |
| সাধারণ শিক্ষা/উচ্চশিক্ষা | দাওরায়ে হাদীস (তাকমীল) | কামিল (মাস্টার্স) | দাওরায়ে হাদীস সনদটি মাস্টার্স (Master’s Degree)-এর সমমান। (২০১৮ সালের আইন অনুযায়ী) |
| পেশাগত ক্ষেত্র (নিকাহ নিবন্ধন) | দাওরায়ে হাদীস (তাকমীল) | আলিম | নতুন বিধিমালা (যা আপনি আপলোড করেছেন) অনুযায়ী, নিকাহ নিবন্ধক (কাজী) নিয়োগের জন্য তাকমীল সনদকে আলিম সনদের সমতুল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। |
৩. মূল সিদ্ধান্ত
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে: কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদীস মাস্টার্স সমমানের, যা আলিয়া মাদ্রাসার আলিম (HSC সমমান) ডিগ্রির চেয়ে উচ্চতর।
কাজী নিয়োগের ক্ষেত্রে: নির্দিষ্ট পেশাগত প্রয়োজনে, সরকার বর্তমানে দাওরায়ে হাদীস সনদকে আলিয়া মাদ্রাসার আলিম সনদের সমতুল্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ, যে কোনো একটি সনদ থাকলেই কাজী পদে আবেদন করা যাবে।
সংক্ষেপে বলা যায়, কওমি দাওরায়ে হাদীস (তাকমীল) সাধারণ শিক্ষার মানদণ্ডে আলিমের চেয়ে উচ্চ হলেও, নিকাহ নিবন্ধনের মতো বিশেষ পেশাগত ক্ষেত্রে উভয়কেই সমতুল্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
