সূচীপত্র
ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে মাঠ পর্যায়ে ভূমি জরিপ পরিচালিত হয় – ভূমি জরিপ ইতিহাস
জমির খতিয়ান কি? – ভূমি জরিপ হচ্ছে ভূমির মালিকানা সম্বলিত ইতিহাসের সরেজমিন ইতিবৃত্ত। আইনী সংজ্ঞা হচ্ছে, The Survey Act, 1875 এর ২ ধারা অনুযায়ী, ‘জরিপ’-এর অন্তর্ভুক্ত হইবে সীমানা চিহ্নিতকরণ, নদীতীর বরাবর ক্ষয়প্রাপ্ত বা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জমি, নদীর গতি পরিবর্তনের ফলে পুনঃউদ্ভব বা নূতন উদ্ভবকৃত জমির পরিমাণ নির্ধারণ এবং জরিপের সহিত যুক্ত পূর্ববর্তী সকল কার্যক্রম। একটি ভূমির মালিক কে এবং তার সীমানা কতটুকু এটা ভূমি জরিপের মাধ্যমে নকশা/ম্যাপ নির্ণয় করা হয়। এই নকশা এবং ম্যাপ অনুসারে মালিকানা সম্পর্কিত তথ্য যেমন ভূমিটি কোন মৌজায় অবস্থিত, এর খতিয়ান নম্বর, ভূমির দাগ নম্বর, মালিক ও দখলদারের বিবরণ ইত্যাদি প্রকাশিত হয় যাকে খতিয়ান বলে। রেকর্ড বা জরিপ প্রচলিতভাবে খতিয়ান বা স্বত্ত্বলিপি বা Record of Rights (RoR) নামেও পরিচিত।
জনগণ কিভাবে জানবে জরিপ হবে? ভূমি জরিপ আরম্ভের পূর্বে ১৯৫০ সনের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের ১৪৪(১) ধারা এবং বঙ্গীয় জরিপ আইনের ৩ ধারায় ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে সেটেলমেন্ট অফিসার কর্তৃক ৫ ও ৭ ধারার নোটিশ প্রদান। জরিপ শুরুর পূর্বে মাইকিং ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিসহ ব্যাপক জনসংযোগ করা হয়। এসময় ভূমি মালিকগণকে নিজ নিজ জমির আইল/ সীমানা চিহ্নিত করে রাখতে হবে। জমির মালিকানার সমস্ত দলিল/ কাগজপত্র হালনাগাদ অবস্থায় কাছে রাখতে হবে।
কোন মৌজার নকশা সম্পূর্ণ নতুন করে প্রস্তুত করতে মৌজায় যে কাঠামো স্থাপন করা হয় সেটাই ট্রাভার্স। অতঃপর পি-৭০ সিটের মাধ্যমে মৌজার নতুন নকশা প্রস্ত্তত করা হয়। কোন মৌজার পুরোনো নকশা অর্থাৎ ব্লু-প্রিন্ট সিটের উপর জরিপ করার ক্ষেত্রে ট্রাভার্স করা হয় না। ট্রাভার্স পরিচালনা করেন একজন সার্ভেয়ারের নেতৃত্বে একদল জরিপ কর্মচারী।
ভূমি জরিপ কিভাবে করা হয়? । ভূমি জরিপ কত কত সালে হয়েছিল? । জরিপের ইতিহাস কি?
কিস্তোয়ার- এই স্তরে আমিন দল প্রতি খন্ড জমির পরিমাপ করে তা মৌজার নকশায় প্রতিফলিত করে নতুন নকশা অংকনের মাধ্যমে কিস্তোয়ার সম্পন্ন করে অথবা ব্লু-প্রিন্টে পুরোনো নকশা সংশোধন করেন।
আপত্তির রায়ে সংক্ষুদ্ধ পক্ষ ৩১ বিধিতে আপীল দায়ের করতে পারেন। নির্ধারিত কোর্ট ফি এবং কার্টিজ পেপারসহ সেটেলমেন্ট অফিসার বরাবর আবেদন দাখিলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আপত্তি মামলার রায়ের ঐ নকলসহ আপীল দায়ের করতে হবে। সংশ্লিষ্ট পক্ষকে নোটিশ মারফত জ্ঞাত করে নির্দিষ্ট তারিখ, সময় ও স্থানে শুনানী গ্রহন করে আপীল নিস্পত্তি করা হয়।
বাংলাদেশের জরিপ সমূহ । সিএস জরিপ হতে দিয়ারা জরিপ কখন পরিচালি হয়েছে?
- ১) সি.এস. জরিপ/রেকর্ড (Cadastral Survey)- “সিএস” হলো Cadastral Survey (CS) এর সংক্ষিপ্ত রূপ। একে ভারত উপমহাদেশের প্রথম জরিপ বলা হয় যা ১৮৮৮ সাল হতে ১৯৪০ সালের মধ্যে পরিচালিত হয়। এই জরিপ ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাতন্ত্র আইনের ১০ম পরিচ্ছেদে অনুসারে সিলেট ও পার্বত্য জেলা ব্যতীত সারা দেশে পরিচালিত হয়। উক্ত জরিপের মাধ্যমে জমির বিস্তারিত মৌজা নকশা (ম্যাপ) প্রস্তুত করা হয় এবং প্রত্যেক মালিকের জন্য দাগ নম্বর উল্লেখপুর্বক ভূমির বাস্তব অবস্থা, আয়তন, শ্রেণী, পরিমাণ, খাজনার পরিমাণ ইত্যাদি উল্লেখপূর্বক খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়। এ জরিপ পি-৭০ সীটে কিস্তোয়ারের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। সিএস জরিপ ১৮৮৮ সালে কক্সবাজারের রামু থানা হতে আরম্ভ হয় এবং ১৯৪০ সালে দিনাজপুর জেলায় শেষ হয়। সে সময়ে সিলেট জেলা আসাম প্রদেশের অধীন থাকায় সিলেট জেলায় সিএস জরিপ হয়নি। তবে জরুরী বিবেচনায় ১৯৩৬ সালের সিলেট প্রজাস্বত্ব আইনের (Sylhet tenancy Act) আওতায় সিলেট জেলার ক্যাডাষ্ট্রাল সার্ভে ১৯৫০ সালে আরম্ভ করা হয় এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহন ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর অধীনে ঐ জরিপ ১৯৬৩ সালে শেষ হয়। সি.এস. জরিপে সময় প্রস্তুতকৃত খতিয়ানে জমিদারগণের নাম খতিয়ানের উপরিভাগে এবং দখলকার রায়তের নাম খতিয়ানের নিচে লেখা হত। সে সময় জমিদারগণ সরকার পক্ষে জমির মালিক ছিলেন এবং রায়তগণ প্রজা হিসেবে শুধুমাত্র ভোগ দখলকার ছিলেন। প্রথম জরিপ এই জরিপ এবং প্রস্তুতকৃত নকশা ও খতিয়ান খুবই নিখুঁত ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে এখনো গ্রহণীয়। মামলার বা ভূমির জটিলতা নিরসনের ক্ষেত্রে এই জরিপকে বেস হিসেবে অনেক সময় গণ্য করা হয়।
- ২) এস.এ. জরিপ (State Acquisition Survey)- ১৯৫০ সালে জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হওয়ার পর সরকার ১৯৫৬ সালে সমগ্র পূর্ববঙ্গ প্রদেশে জমিদারী অধিগ্রহনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২/৪/১৯৫৬ তারিখে এই আইনের ৩ ধারার আওতাধীন বিজ্ঞপ্তির মূলে সরকার কর্তৃক সকল জমিদারি দখল নেয়ার পর উক্ত এ্যাক্টের ১৭ ধারা মোতাবেক যে খতিয়ান প্রস্তুত করা হয় তা এস এ খতিয়ান বলে পরিচিত। মূলত, জমিদারী ও মধ্যস্বত্ব বিলোপ করে জমিদারগণকে প্রদেয় ক্ষতিপূরণ তালিকা প্রণয়ন এবং ভূমি মালিকগণকে/রায়তকে সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আনয়ন করার লক্ষ্যে সে সময় একটি সংক্ষিপ্ত জরিপ ও রেকর্ড সংশোধনী কার্যক্রম পরিচালিত হয় যা পরবর্তীতে এসএ খতিয়ান বলে পরিচিত পায় । ১৯৫৬ হতে ১৯৬২ পর্যন্ত এই জরিপ পরিচালিত হয়। জরিপে ভূমি মালিকের নাম ও জমির বিবরণাদি সম্বলিত হাতেলেখা রেকর্ড/খতিয়ান প্রস্তুত করা হয় । সে সময় এই রেকর্ড মোট তিন কপি প্রস্তুত করা হয় যার মধ্যে একটি জেলা রেকর্ড রুমে, এক কপি তহশলি ( ইউনিয়ন ভূমি অফিস) অফিসে এবং অন্যটি সার্কেল পরিদর্শক (উপজেলা রাজস্ব) অফিসে প্রদান করা হয় । জরুরী তাগিদে জমিদারগন হইতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই জরিপ বা খাতিয়ান প্রণয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল।
- ৩) পি.এস. জরিপ (Pakistan Survey)- এস.এ. জরিপকেই পি.এস. জরিপ বলে। ১৯৫৬ হতে ১৯৬২ পর্যন্ত এই জরিপ পরিচালিত হয়।
- ৪) আর.এস. জরিপ ( Revisional Survey)- সি.এস. জরিপ সম্পন্ন হওয়ার সুদীর্ঘ ৫০ বছর পর এই জরিপ পরিচালিত হয়। জমির অবস্থা, প্রকৃতি, মালিক, দখলদার ইত্যাদি হালনাগাদ করার লক্ষ্যে এ জরিপ সম্পন্ন করা হয়। এস.এ. জরিপের সময় সরেজমিনে তদন্ত বা জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা হয়নি। জমিদারদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এস.এ জরিপ বা খাতিয়ান প্রস্তুত করা হয়েছিল যার কারণে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যায়। এই ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার জন্য সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরেজমিনে ভূমি জরিপ করার সিদ্ধান্ত নেয় যা আর.এস বা Revisional Survey জরিপ হিসেবে পরিচিত। এই জরিপে প্রস্তুতকৃত নকশা (ম্যাপ) এবং খতিয়ান নির্ভূল হিসেবে গ্রহণীয়।
- ৫) বিএস জরিপ (Bangladesh Survey)- বিএস জরিপ হলো মূলত বাংলাদেশ সার্ভে এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ১৯৫০ সালের জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী এই জরিপ কার্য পরিচালিত হয়। ১৯৯৮ সাল হতে বর্তমানে চলমান জরিপকে বিএস খতিয়ান বা সিটি বলা হয়। যা এখনো সারা দেশে চলমান। শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীতে বিএস খতিয়ানকে সিটি জরিপ বলা হয় এই সিটি জরিপের আরেক নাম ঢাকা মহানগর জরিপ। আর এস জরিপের পর বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৮ সাল থেকে এ জরিপের উদ্যোগ নেয় এ যাবৎকালে এটিই হলো আধুনিক জরিপ।
- ৬.সিটি জরিপ (City Survey)- সিটি জরিপ এর আর এক নাম ঢাকা মহানগর জরিপ। আর.এস. জরিপ এর পর বাংলাদেশ সরকার কর্তিক অনুমতি ক্রমে এ জরিপ ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে সম্পন্ন করা হয়। এ যাবত কালে সর্বশেষ ও আধুনিক জরিপ এটি। এ জরিপের পরচা কম্পিউটার প্রিন্ট এ পকাশিত হয়।
- ৭) দিয়ারা জরিপ- দিয়ারা জরিপ হলো দরিয়া সম্পর্কিত জরিপ। জেগে উঠা নতুন ভূখন্ড (চর) জেলা প্রশাসকের চাহিদার ভিত্তিতে সিকস্তি পয়স্তির কারণে ভৌগলিক সীমারেখা ও স্বত্বের পরিবর্তন হলে নদী ও সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় নতুন জরিপ করা হয়। এ সমস্ত জরিপে নকশা ও রেকর্ড প্রস্তুত করা হয়। এটি অতি পুরাতন জরিপ। ক্যাডাস্ট্রাল জরিপ আরম্ভ হয় ১৮৮৮ সালে, পক্ষান্তরে দিয়ারা জরিপ আরম্ভ হয় ১৮৬২ সালে। দিয়ারা জরিপে সাধারন জরিপের জন্য প্রযোজ্য সকল স্তর অনুসরন করে পয়স্তি ভূমির(চর) নক্সা ও রেকর্ড প্রস্তুত করা হয় দিয়ারা সেটেলমেন্ট অফিসারের নেতৃত্বে ৪টি (রাজশাহী, নরসিংদী, চট্রগ্রাম ও বরিশাল) বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক অফিস ও ক্যাম্পের মাধ্যমে সারাদেশের সুনির্দির্ষ্ট কিছু মৌজায় এ জরিপ কাজ পরিচালিত হয়।
তসদিক ও খসড়া প্রকাশনা কি?
ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে তসদিক স্তরের কাজ সম্পাদিত হয়। তসদিক স্তরের কাজ সম্পাদন করেন একজন কানুনগো বা রাজস্ব অফিসার। জমির মালিকানা সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র ও প্রমাণাদি যাচাই করে প্রতিটি বুঝারত খতিয়ান সত্যায়ন করা হয়। এ স্তরেও ভূমি মালিকগণ পর্চা ও নকশার কোন সংশোধন প্রয়োজন মনে করলে বিবাদ (Dispute) দাখিল করতে পারেন এবং উপযুক্ত প্রমান উপস্থাপন করে তা সংশোধনের সুযোগ নিতে পারেন। তসদিককৃত পর্চা জমির মালিকানায় প্রাথমিক আইনগত ভিত্তি (Primary Legal Document) হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই এ স্তরের কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তসদিকের পর জমির প্রণীত রেকর্ড সর্ব সাধারণের প্রদর্শনের জন্য ৩০ দিন উম্মুক্ত রাখা হয়। এর সময়কাল উল্লেখপূর্বক ক্যাম্প অফিস হতে বিজ্ঞপ্তিও প্রচার করা হয়। ভূমি মালিকগণের নামের অদ্যাক্ষর অনুযায়ী খতিয়ান বা পর্চা বর্ণনাক্রমিক ক্রমবিন্যাস করে খতিয়ানে নতুন নম্বর দেওয়া হয়। ডিপি নম্বরটি সংগ্রহের জন্য ভূমি মালিকগণকে নিজ নিজ পর্চাসহ খসড়া প্রকাশনা (ডিপি) ক্যাম্পে উপস্থিত হতে হয়। ডিপিতে প্রকাশিত খতিয়ান সম্পর্কে কারো কোন আপত্তি বা দাবি থাকলে সরকার ১০ (দশ) টাকার কোর্ট ফি দিয়ে নির্দিষ্ট ফরম পূরণের মাধ্যমে প্রজাস্বত্ব বিধিমালার ৩০ বিধি অনুযায়ী আপত্তি দায়ের করা যাবে।